কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোনও স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণে ইট একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও কেউ কেউ ইটের বিকল্প হিসেবে বালু ও সিমেন্টের তৈরি ব্লক ব্যবহার করছেন। কিন্তু তা খুব একটা আগ্রহ তৈরি করেনি। এছাড়া ব্লকের দাম ও তা টেকসই হবে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাই এখন পর্যন্ত ইটের কোনও বিকল্প নেই। তবে ইট তৈরি করতে গিয়ে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইটভাটা স্থাপনের জায়গা ও পরিচালনা পদ্ধতি নিয়েও আছে প্রশ্ন। ফলে একদিকে ইটভাটার মালিকরা যেমন আইনের পরিবর্তন চান, তেমনি সরকারও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন সংশোধন নিয়ে ভাবছে।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে মোট ইটভাটা রয়েছে ৭ হাজার ৮৮১টি। আর দেশে বছরে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইট তৈরি হয়।
বিধিমালা
জানা গেছে, ইটভাটা স্থাপনের আগে অবশ্যই প্রয়োজন হয় লাইসেন্সের। নির্ধারিত ফি দিয়ে পরিবেশ অধিদফতর থেকে নিতে হয় এই লাইসেন্স। লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা চালানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে যেকোনও সময় জরিমানা করা হতে পারে।
সাধারণত ইট তৈরির ক্ষেত্রকে বলা হচ্ছে ইটের ভাটা। ইটভাটা তৈরি করা হয় অনুৎপাদনশীল কৃষি জমিতে, অর্থাৎ যেখানকার মাটি কৃষিকাজের জন্য অনুপযোগী সেই জমিতে। জমিটি হতে হবে অবশ্যই ফসলি জমি থেকে দূরে। কারণ, কোনোভাবেই ইট বানাতে গিয়ে ফসলি জমি নষ্ট করা যাবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইট পোড়ানোর কাজে আজকাল কয়লা ব্যবহার করা হয়। আগে গাছ ব্যবহার করা হলেও এখন তা নিষিদ্ধ। সাধারণত ৫ থেকে ১২ দিন রোদে শুকানোর পর ইটখোলা ইটভাটার ভেতরে পোড়ানোর জন্য সাজানো হয়। ভাটার ভেতরে ইট পোড়ানোর সময় তাপের অপচয় রোধের জন্য ইটের গুঁড়া দিয়ে আস্তরণ দেওয়া হয়। জ্বালানি গ্যাসের সংযোগবিহীন ইটখোলাগুলোতে ইট পোড়ানো শুরু হয় জ্বালানি কাঠ দিয়ে। পরবর্তী সময়ে সেগুলোতে কয়লা ব্যবহার করা হয়। অপেক্ষাকৃত সস্তা হওয়ায় ইটখোলায় ব্যবহারের জন্য ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হয়। কয়লার বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কাঠের গুঁড়া, ফার্নেস অয়েল, এমনকি গাড়ির বাতিল টায়ারও পোড়ানো হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গ্যাস নেটওয়ার্কের কাছাকাছি। এ কারণে এই এলাকায় প্রায় ২০০টি ইটখোলায় জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়।
আইন সংশোধন করতে চায় সরকার
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালের পর আবারও ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯)-এর সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামতও রয়েছে। কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে বলছেন, এত তাড়াতাড়ি আইনের সংশোধন না করে আরও কিছুটা সময় নিয়ে আইন সংশোধন করা যেতে পারে। তবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতেই এই আইনের সংশোধন প্রয়োজন। এর মূল কারণ দেশের ফসলি জমি রক্ষা করা। যেখানে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ফসলি জমিতে ইটভাটা গড়ে তোলার ফলে খাদ্য উৎপাদন অনেকটাই ঝুঁকিতে পড়েছে। এর জন্য সময় দেওয়া হলেও আইনের দুর্বলতার কারণে অপরিকল্পিত ইটভাটাগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়নি।
এদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী, নতুন ইটভাটা স্থাপনের কোনও সুযোগ নেই। প্রচলিত ইটভাটাগুলো আধুনিক দূষণমুক্ত ইটভাটায় রূপান্তর করার বিষয়ে ভাটা মালিকরাও একমত। অবৈধ ইটভাটাগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য সময় দেওয়ার পরেও সেগুলো সরিয়ে না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই তারা ইটভাটা আইন সংশোধনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের আইনের ৮(৪) ধারায় নির্ধারিত সীমারেখাবহির্ভূত অবৈধ ভাটাগুলো যথাস্থানে স্থানান্তর করার জন্য দুই বছর সময় দেওয়া হয়। অন্যথায় তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। সেই অবৈধ ভাটাগুলো এখনও চালু আছে কিনা, তা দেখা প্রয়োজন। আইন অনুযায়ী, একটি ইটভাটা থেকে এক কিলোমিটার দূরত্ব রেখে পরবর্তী ইটভাটা নির্মাণের বিধান থাকলেও পাশাপাশি গড়ে তোলা হচ্ছে ইটভাটা।
অনুৎপাদনশীল জমি বিবেচনায় না নিয়ে ফসলি জমি, এমনকি তিন ফসলি জমিতেও ইটভাটা গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে বিঘায় বিঘায় ফসলি জমি উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। কারণ, ইট তৈরিতে পাশের জমি থেকে মাটি তুলে নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ইটভাটা এলাকায় বানানো চুলার আগুন অন্য জমিকে উত্তপ্ত করছে। এতে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাচ্ছে জমি।
জানা গেছে, বিদ্যমান আইনের ৮(৩)(খ) ও ৮ (৩)(ঙ) ধারায় বলা আছে, কোনও ব্যক্তি নিকটবর্তী দূরত্বে বা স্থানে ইটভাটা স্থাপন করতে পারবে না সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে, বিশেষ কোনও স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা অনুরূপ কোনও স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে করতে হবে। এই ধারাগুলো পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন দাখিল করে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে গুণগত মানসম্পন্ন ইট তৈরির জন্য বিদ্যমান আইন বা বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। পরে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯)-এর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের ২৬টি ধারার মধ্যে ১৯টি ধারা-উপধারা সংশোধনের প্রস্তাব পাঠায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ অধিদফতর।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ৭ হাজার ৮৮১টি ইটভাটার মধ্যে জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটা প্রায় ৮১ শতাংশ। লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ছাড়া আইনের অন্যান্য শর্ত বিবেচনা করা হয়। ৮১ শতাংশ জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটাকে ছাড়পত্র নবায়নের ক্ষেত্রে মালিক সমিতির আইনের শর্ত শিথিলের আবেদন জানিয়েছে বলেও জানা গেছে। কারণ, এই পদ্ধতিতে নির্মিত চিমনির উচ্চতা ১২৫ ফুটের বেশি। যা পরিবেশ সহায়ক। প্রতিটি চিমনি বানাতে ব্যয় হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। তবে অন্যান্য শর্ত অমান্য করে তৈরি করা হয়েছে অনেক ইটভাটা।
অধিদফতর বিদ্যমান আইনের ধারা ৮(৩)(খ)-এর বিষয়ে আইনের শর্ত বহাল রাখার পক্ষে পরিবেশ অধিদফতর মতামত দিলেও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকায় জিগজ্যাগ পদ্ধতির সেসব অবৈধ ইটভাটাগুলো নবায়ন করা হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ মুহূর্তে এর বেশি বলা ঠিক হবে না।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলায় অবৈধভাবে অসংখ্য ইটভাটা গড়ে উঠেছে। যথাযথ মনিটরিং করা হচ্ছে না। এ নিয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে কয়েকটি। সেসব আদেশ না মানায় আদালত অবমাননার অভিযোগেও মামলা করা হয়েছে। তাই আদালতের পাশাপাশি সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর ভূমিকা পালন করা জরুরি।’