মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য এবং পৃথিবীতে তাঁর বিধান কায়েম করার জন্য। এ লক্ষ্যে মানবতার সঠিক পথের দিশারী হিসাবে এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন (আহমাদ, ত্বাবারানী, মিশকাত হা/৫৭৩৭)। তাঁরা যুগে যুগে মানুষকে সত্য-সুন্দরের পথ, কল্যাণের পথ, হেদায়াতের পথ প্রদর্শন করেছেন। সে পথে মানুষকে পরিচালনার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় ও তার কুমন্ত্রণায় হক্বের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কখনোবা এ পথে মানুষ যাতে আসতে না পারে সেজন্য বাধা সৃষ্টি করেছে। ফলে ঐসব মানুষও শয়তানের ন্যায় অভিশপ্ত হয়েছে, জান্নাতের পরিবর্তে জাহান্নামের কীটে পরিণত হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে হক্বের পথে, আল্লাহর পথে তথা দ্বীনের পথে বাধা দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
দ্বীনী কাজে বাধা প্রদানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: মহান আল্লাহ আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করে জ্বিন-ফিরিশতা সবাইকে নির্দেশ দেন আদমকে সিজদা করার জন্য। সবাই নির্দেশ মেনে আদমকে সিজদা করলেও ইবলীস অহংকারবশত: আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয় (বাক্বারাহ ২/৩৪)। আদমের কারণে যেহেতু ইবলীসের উচ্চ মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়, সেজন্য সে আদম ও তাঁর সন্তানদের প্রতি ঈষাপরায়ণ হয়ে পড়ে। সে মানুষের চিরশত্রুতে পরিণত হয়। শুরু হয় তার চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র ও মানুষকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা। সে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মানুষকে কুফরী করতে প্ররোচিত করে। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ কুফরীতে লিপ্ত হ’লে সে বলে, ‘আমি তোমার থেকে মুক্ত এবং আমি মহান আল্লাহ্কে ভয় করি’ (হাশর ৫৯/১৬)।
ইবলীসের এই ধোঁকা দান শুরু হয় প্রথম মানব আদম (আ:)-এর সময় থেকে। আল্লাহ আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি করে বললেন, ‘তোমরা দু’জনে জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান থেকে যা খুশি খাও। তবে এই গাছটির নিকটে যেও না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৫)। কিন্তু ইবলীস আদম ও হাওয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণার ফাঁদ পাতলো। সে প্রথমে তাদের স্বজনে পরিণত হ’ল। নানা কথায় সুকৌশলে তাদের প্ররোচিত করতে লাগল ঐ নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার জন্য। এক পর্যায়ে সে বলল, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে ঐ গাছটির নিকটে যেতে নিষেধ করেছেন এজন্য যে, তোমরা তাহ’লে ফেরেশতা হয়ে যাবে কিংবা তোমরা এখানকার চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। এরপর সে শপথ করে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাংখী’। এভাবে সে আদম ও হাওয়াকে রাযী করে। তার প্রতারণার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে তাঁরা উভয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল ভক্ষণ করেন। ফলে তৎক্ষণাৎ তাদের লজ্জাস্থান প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তাঁরা গাছের পাতা দ্বারা লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেন। তখন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ গাছের নিকটবর্তী হ’তে বারণ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’? তখন তাঁরা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে (আ‘রাফ ৭/২০-২২)। এভাবে শয়তান প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়া (আ:)-কে আল্লাহদ্রোহী কাজে লিপ্ত করে এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
আদম (আ:)-এর এক হাজার বছর পরে পৃথিবীতে আগমন করেন নূহ (আ:)। আদম (আ:)-এর সময় শিরক ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে মানব সমাজে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। নূহ (আ:)-এর সম্প্রদায়ে ওয়াদ, সু‘আ, ইয়াগূছ, ইয়াউক্ব ও নাসর নামক পাঁচজন সৎকর্মশীল লোক ছিলেন। তাদের মৃত্যুর পর সে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের অসীলায় পরকালে মুক্তির আশায় তাদের পূজা আরম্ভ করে। সে সময়ে শয়তান ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের এ বলে প্ররোচনা দেয় যে, এসব সৎকর্মশীল মানুষের মূর্তি বা প্রতিকৃতি সামনে থাকলে, তাদের দেখে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। ফলে লোকেরা তাদের মূর্তি তৈরী করে। এরপর ঐসকল লোকদের মৃত্যুর পরে তাদের পরবর্তীরা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ঐ মূর্তিগুলোকে সরাসরি পূজা করতে আরম্ভ করে। এসব মূর্তির অসীলায় তারা বৃষ্টি প্রার্থনা করত (ইবনু কাছীর, সূরা নূহ দ্র:; বুখারী, ‘তাফসীর’ অধ্যায়, হা/৪৯২০)। এভাবে পৃথিবীতে মূর্তিপূজা শুরু হয়। শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহর উপাসনার স্থলে মূর্তি পূজা জায়গা দখল করে নেয়।
কওমে মূসা তথা বনী ইসরাঈল শয়তানের প্ররোচনায় গো-বৎসের পূজা আরম্ভ করেছিল। মূলত: তারা শয়তানের কারণে আল্লাহর দ্বীনের কাজ পরিহার করে শয়তানী কাজ শুরু করে। এ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরূপ- আল্লাহ পাক যখন মূসা (আ:)-কে ওয়াদা দিলেন যে, তুমি বনী ইসরাঈলকে নিয়ে তূর পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে চলে এস, আমি তোমাকে তাওরাত দান করব। যা তোমার ও তোমার সম্প্রদায়ের জন্য কর্মপন্থা নির্দেশ করবে। তখন তিনি বনী ইসরাঈলকে নিয়ে তূর পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আর তিনি হারূন (আ:)-এর নেতৃত্বে তার সম্প্রদায়কে পশ্চাতে আসার নির্দেশ দিয়ে নিজে সাগ্রহে আগে চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে ৪০ দিন অবস্থান করলেন। তিনি ভাবলেন যে, তাঁর কওম নিশ্চয়ই তাঁর পিছে পিছে তুর পাহাড়ের সন্নিকটে এসে শিবির স্থাপন করেছে। কিন্তু তাঁর ধারণা সঠিক ছিল না। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে মূসা! তোমার সম্প্রদায়কে পিছনে ফেলে তুমি দ্রুত চলে এলে কেন? তিনি বললেন, তারা তো আমার পিছে পিছেই আসছে। হে প্রভু! আমি তাড়াতাড়ি তোমার কাছে এলাম, যাতে তুমি খুশী হও। আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি তোমার পর এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৩-৮৫)।
একথা জেনে মূসা (আ:) আশ্চর্য হ’লেন। দু:খে ও ক্ষোভে অস্থির হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘আর মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন ক্রুদ্ধ ও অনুতপ্ত অবস্থায়। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের একটি উত্তম প্রতিশ্রুতি দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির সময়কাল তোমাদের কাছে দীর্ঘ হয়েছে? না-কি তোমরা চেয়েছ যে তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার ক্রোধ নেমে আসুক, যে কারণে তোমরা আমার সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করলে? তারা বলল, আমরা আপনার সাথে কৃত ওয়াদা স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি। কিন্তু আমাদের উপরে ফেরাঊনীদের অলংকারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অত:পর আমরা তা নিক্ষেপ করে দিয়েছি, এমনিভাবে সামেরীও নিক্ষেপ করেছে। অত:পর সে তাদের জন্য বের করে আনলো একটা গো-বৎসের অবয়ব, যার মধ্যে হাম্বা হাম্বা রব ছিল। তারপর (সামেরী ও তার লোকেরা) বলল, এটা তোমাদের উপাস্য এবং মূসারও উপাস্য, যা পরে মূসা ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৬-৮৮)।
আসল ঘটনা এই ছিল যে, মিসর থেকে বিদায়ের দিন যাতে ফেরাঊনীরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন না করে এবং তারা কোনরূপ সন্দেহ না করে, সেজন্য (মূসার অলক্ষ্যে) বনু ইসরাঈল প্রতিবেশী ক্বিবতীদের কাছ থেকে অলংকারাদি ধার নেয় এই বলে যে, আমরা সবাই ঈদ উৎসব পালনের জন্য যাচ্ছি। দু’একদিনের মধ্যে ফিরে এসেই তোমাদের সব অলংকার ফেরৎ দিব। কিন্তু সাগর পার হওয়ার পর যখন আর ফিরে যাওয়া হ’ল না, তখন কুটবুদ্ধি সম্পন্ন মুনাফিক সামেরী মনে মনে এক ফন্দি আটল যে, এর দ্বারা সে বনু ইসরাঈলকে পথভ্রষ্ট করবে। ফলে মূসা (আ:) তাঁর সম্প্রদায়কে হারূণের দায়িত্বে রেখে তিনি আগেভাগে তূর পাহাড়ে চলে গেলে সামেরী সুযোগ বুঝে তার ফন্দি কাজে লাগায়। সাগর ডুবি থেকে নাজাত লাভের সময় চতুর সামেরী জিব্রীলের অবতরণ ও তাঁর ঘোড়ার প্রতি লক্ষ্য করে দেখল যে, জিব্রীলের ঘোড়ার পা যে মাটিতে পড়ছে, সে স্থানের মাটি সজীব হয়ে উঠছে ও তাতে জীবনের স্পন্দন জেগে উঠছে। তাই সবার অলক্ষ্যে এ পদচিহ্নের এক মুঠো মাটি সে তুলে সযতনে রেখে দেয়।
মূসা (আ:) তুর পাহাড়ে চলে যাবার পর সে লোকদের বলে, তোমরা ফেরাঊনীদের যেসব অলংকারাদি নিয়ে এসেছ এবং তা ফেরত দিতে পারছ না, সেগুলি ভোগ-ব্যবহার করা তোমাদের জন্য বৈধ হবে না। তাই সেগুলি একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দাও। কথাটি হারূন (আ:)-এরও কর্ণগোচর হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণিত একটি হাদীছ থেকে জানা যায় যে, হারূন (আ:) সব অলংকার একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেন, যাতে সেগুলি একটি অবয়বে পরিণত হয় এবং মূসা (আ:)-এর ফিরে আসার পর এ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণ করা যায়। হারূণ (আ:)-এর নির্দেশ মতে সবার অলংকার গর্তে নিক্ষেপ করার সময় সামেরীও হাতের মুঠি বন্ধ করে সেখানে পৌঁছল। সে হারূণ (আ:)-কে বলল, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক- এই মর্মে আপনি দোয়া করলে আমি নিক্ষেপ করব অন্যথা করব না। হারূণ তার কপটতা বুঝতে না পেরে সরল মনে দো‘আ করলেন। আসলে তার মুঠিতে ছিল জিব্রীলের ঘোড়ার পায়ের সেই অলৌকিক মাটি। ফলে উক্ত মাটির প্রতিক্রিয়ায় হোক কিংবা হারূনের দোয়ার ফলে হোক সামেরীর উক্ত মাটি নিক্ষেপের পরপরই গলিত অলংকারাদির অবয়বটি একটি গো-বৎসের রূপ ধারণ করে হাম্বা হাম্বা রব করতে শুরু করে। মুনাফিক সামেরী ও তার সঙ্গী-সাথীরা এতে উল্লসিত হয়ে বলে উঠল, এটাই হ’ল তোমাদের উপাস্য ও মূসার উপাস্য। যা সে পরে ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৮)।
অপরদিকে মূসা (আ:)-এর তূর পাহাড়ে গমনকে সে অপব্যাখ্যা করে বলল, মূসা বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। এখন তোমরা সবাই এ গো-বৎসের পূজা কর। কিছু লোক তার অনুসরণ করল। ফলে মূসা (আ:)-এর পিছে পিছে তূর পাহাড়ে গমনের প্রক্রিয়া পথিমধ্যেই বানচাল হয়ে যায়। অত:পর মূসা (আ:) এসে সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে সব কথা শুনলেন। হারূন (আ:) তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। সামেরীও তার কপটতার কথা অকপটে স্বীকার করল। এরপর মূসা (আ:) আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী শাস্তি ঘোষণা করলেন। মূসা (আ:) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন (বাক্বারাহ ২/৫৪)। এতে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। সম্প্রদায়ের লোকদের শাস্তি দানের পর মূসা (আ:) এবার সামেরীকে ঘটনা জিজ্ঞেস করলেন। সামেরী আনুপূর্বিক ঘটনা বর্ণনা করল। এরপর বলল, আমার মন এটা করতে প্ররোচিত করেছিল। অর্থাৎ কারো পরামর্শে নয়; বরং নিজস্ব চিন্তায় ও শয়তানী কুমন্ত্রণায় আমি একাজ করেছি। মূসা বললেন, তোমার জন্য সারা জীবন এই শাস্তিই রইল যে, তুমি বলবে, আমাকে কেউ স্পর্শ করো না এবং তোমার জন্য আখেরাতে একটা নির্দিষ্ট ওয়াদা রয়েছে, যার ব্যতিক্রম হবে না। সেটা হ’ল জাহান্নাম। এক্ষণে তুমি তোমার সেই ইলাহের প্রতি লক্ষ্য করো, যাকে তুমি সর্বদা পূজা দিয়ে ঘিরে থাকতে। আর আমরা ঐ কৃত্রিম গো-বৎসটাকে অবশ্যই জ্বালিয়ে দেব এবং অবশ্যই ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছিটিয়ে দেব (ত্বোয়াহা ২০/৯৫-৯৭)। এভাবে বানী ইসরাঈল শয়তানের প্ররোচনায় আল্লাহদ্রোহী কাজে লিপ্ত হয়েছিল।
কেবল পূর্ববর্তী উম্মতের ক্ষেত্রেই নয়; বরং ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেও শয়তানের ঐ প্ররোচনা অব্যাহত আছে। বদর যুদ্ধের সময় ইবলীস সুরাকা বিন মালেক বিন জুশুম মুদলিজীর আকৃতিতে এসে মুশরিকদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হ’তে প্ররোচিত করেছিল এবং সে মুশরিকদের সাথেই ছিল। কিন্তু যখন সে মুশরিকদের বিরুদ্ধে ফিরিশতাদের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করল, তখন সে পিছনে ফিরে পলায়ন করতে থাকল। এ সময় হারেছ বিন হিশাম তাকে আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করল। তখন ইবলীস তার বুকে সজোরে ঘুষি মারলে হারেছ মাটিতে পড়ে যায় এবং এই সুযোগে ইবলীস পলায়ন করে। মুশরিকরা তখন বলতে লাগল যে, সুরাকা কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বলনি যে, তুমি আমাদের সাহায্য করবে এবং কখনই আমাদের থেকে পৃথক হবে না? সে বলল, ‘আমি যা দেখছি, তোমরা তা দেখতে পাচ্ছ না। আমি আল্লাহ্কে ভয় করি। তিনি শাস্তি দানে কঠোর’ (আনফাল ৮/৪৮)। এরপর শয়তান পলায়ন করে সমুদ্রের ভিতরে চলে যেতে থাকে (আর-রহীকুল মাখতূম, অনুবাদ: আবদুল খালেক রহমানী ও মুয়ীনুদ্দীন আহমাদ (ঢাকা : তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ২০০৯), পৃ: ২৫৮)।
এভাবে শয়তানী কারসাজিতে যুগে যুগে মানুষ আল্লাহদ্রোহী কাজে লিপ্ত হয়েছে। আদ, ছামূদ, কওমে লূত্ব, আহলে মাদইয়ান প্রভৃতি গোত্র আল্লাহদ্রোহী কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন এবং বিভিন্ন গযব দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। এ পৃথিবীতে নমরূদ, ফিরাউন, কারূণ, হামান, শাদ্দাদ, আবরাহা, আবু জাহল প্রভৃতি প্রতাপশালী মুশরিক রাজা-বাদশাহ ও নেতৃবৃন্দ আল্লাহদ্রোহী কাজ করেছে, আবার মানুষকে সে কাজে উৎসাহিত-উদ্বুদ্ধ করেছে। কখনো তাদেরকে আল্লাহবিরোধী কাজে বাধ্য করেছে। কিন্তু তাদের কারো পরিণতি শুভ হয়নি। সবাইকে আল্লাহ ধবংস করে দিয়েছেন। আর তাদের ইতিবৃত্ত পরবর্তীদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না বলেই এ যুগেও সুনামি, ক্যাটরিনা, সিডর, নার্গিস, ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে আল্লাহ পৃথিবীর মানুষকে সতর্ক-সাবধান করেন। তবে মানুষ খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে। বিপদ-আপদ দূর হয়ে গেলেই তারা আবার অভ্যাসবশত: পূর্বের কাজে ফিরে যায়। আল্লাহ তাঁর প্রিয় সৃষ্টিকে সৎপথে, তাঁর মনোনীত দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। তদুপরি যারা আল্লাহর উপদেশ না মেনে তাঁর অবাধ্য হবে এবং তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা রয়েছে পবিত্র কুরআনে। এ পর্যায়ে বাধা দান সম্পর্কে আল্লাহ প্রদত্ত হুঁশিয়ারী ও হক্বের পথে বাধা দানের পরিণতি সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থাপন করব ইনশাআল্লাহ।
দ্বীনের কাজে বাধা দানে আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা : দ্বীনে হক্বের কাজ মূলত: আল্লাহর নির্দেশ। এ নির্দেশ বাস্তবায়নে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) তাকে বিভিন্নভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দ্বীনী কাজে বাধা প্রদান করতে মহান আল্লাহ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা পথে-ঘাটে একারণে বসে থেকো না যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে হুমকি দিবে, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করবে এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ কর, যখন তোমরা সংখ্যায় অল্প ছিলে অত:পর আল্লাহ তোমাদেরকে অধিক করেছেন এবং লক্ষ্য কর কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে অনর্থকারীদের’ (আ‘রাফ ৭/৮৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বেরিয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোকদেরকে দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর আল্লাহর পথে তারা বাধা দান করত। বস্তুত: আল্লাহর আয়ত্বে রয়েছে সে সমস্ত বিষয় যা তারা করে’ (আনফাল ৮/৪৭)।
দ্বীনের পথে বাধা সৃষ্টি করা শয়তানী কাজ : দ্বীনের পথে বাধা, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা মূলত: শয়তানী কাজ। মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে শয়তান এ কাজ করে আসছে। প্রথম মানব ও প্রথম নবী আদম (আ:) থেকে অদ্যাবধি শয়তানের এ কাজ অব্যাহত আছে। শয়তানের সাথে সাথে কিছু মানুষও দ্বীনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত থেকে তোমাদের বিরত রাখতে। অতএব তোমরা এখনও কি নিবৃত্ত হবে’? (মায়েদাহ ৫/৯১)।
আল্লাহর পথে বাধা দান ইহুদী-নাছারাদের কাজ : আল্লাহর দ্বীনে বাধা দেওয়া ইহুদী-নাছারাদের কাজ। তারা একদিকে নবী-রাসূলগণকে অস্বীকার করতো, অপরদিকে কেউ কেউ আল্লাহর দ্বীনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, হে কিতাবধারীগণ! কেন তোমরা আল্লাহর পথে ঈমানদারদেরকে বাধা দান কর, তোমরা তাদের দ্বীনের মধ্যে বক্রতা অনুপ্রবেশ করানোর পন্থা অনুসন্ধান কর, অথচ তোমরা এ পথের সত্যতা প্রত্যক্ষ করছ। বস্ত্তত: আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অনবগত নন’ (আলে-ইমরান ৩/৯৯)।
আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়া মুনাফিক্বী : মুনাফিকদের অন্যতম আচরণ হচ্ছে বাহ্যিক দিকে এক রকম অন্তরে ভিন্ন। তারা প্রকাশ্যে আল্লাহর পথে থাকার অভিনয় করলেও প্রকৃত পক্ষে দ্বীন থেকে অনেক দূরে থাকে। আল্লাহপাক বলেন, ‘আর যখন বলা হবে, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো, যা তিনি রাসূলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন, তারা আপনার কাছ থেকেও সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে’ (নিসা ৪/৬১)।
দ্বীনের পথে বাধা দান করলে বহু কল্যাণকর জিনিস থেকে বঞ্চিত হ’তে হয় : ইহুদীরা আল্লাহর দ্বীনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। ফলে তাদের জন্য অনেক কল্যাণকর বস্ত্ত হারাম করা হয়, যা পূর্বে তাদের জন্য হালাল ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘বস্তুত: ইহুদীদের জন্য আমি হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র বস্ত্ত, যা তাদের জন্য হালাল ছিল, তাদের পাপের কারণে এবং আল্লাহর পথে অধিক পরিমাণে বাধা দানের দরুন’ (নিসা ৪/১৬০)। অনুরূপভাবে এখনও কেউ আল্লাহর দ্বীনে বাধা দিলে সেও কল্যাণকর বহু জিনিস থেকে বঞ্চিত হবে। (অসমাপ্ত)