পোশাক শিল্প কি সংকটে পড়তে যাচ্ছে

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা অন্য যেকোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পখাত হলো পোশাক শিল্প। রিজার্ভ নিয়ে যে এত কথা, তার একটা বড় অংশ আসে রেডি গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
কিন্তু সম্প্রতি সংকটের মুখে এই পোশাক শিল্প।
বিশ্বজুড়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং পোস্ট কোভিডের ধাক্কায় টালমাটাল অর্থনীতিতে নতুন মাথাব্যথার কারণ হতে যাচ্ছে পোশাক শিল্প। এর মূল কারণ হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় গ্রাহক এসব দেশের বাজারে গত ২ মাসে ক্রয়াদেশ কমেছে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ।
এমন তথ্য জানিয়েছে পোশাক শিল্প রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম সংগঠন বিজিএমইএ। এসব বাজারে রফতানির জন্য পাইপলাইনে থাকা পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ায় এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।
এর সর্বশেষ উদাহরণ খুচরা বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্টের পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়া। ইউরোপে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাতের বড় ক্রেতাদের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠান। যে কারণে বিষয়টি মাথাব্যথার কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি যেন ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে এসেছে। এর সঙ্গে সর্বশেষ সংযোজিত এলাকাভেদে দৈনিক ১ থেকে ২ ঘণ্টা লোডশেডিং প্রভাব ফেলছে উৎপাদনে।
এসব বিষয়ে শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) উত্তরার বিজিএমইএ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি বলেন, আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বছর থেকে টানা প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। টাকার অংকে যা প্রায় ৪২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইতোমধ্যেই জাপানে আমরা ১ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে ভারতে এবং কোরিয়াতেও সমপরিমাণ ব্যবসা করব আশা করছি।
কিন্তু গত দুই মাসে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, ক্রয়াদেশ ক্রমশ কমছে। বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কারখানাগুলোতে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে, ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ডিজেল চালিত জেনারেটরগুলো অব্যাহতভাবে চালানোর ফলে সেগুলো দ্রুত বিকল হচ্ছে।
তিনি বলেন, ক্রয়াদেশ কমার এই প্রভাব এখনো সেভাবে না পড়লেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে বিজিএমইএ কিছু পরামর্শ ও দাবি উপস্থাপন করেছে।
চলমান সংকট কাটাতে রপ্তানি আয়ের ওপর নির্ধারিত উৎসে কর ১ শতাংশই বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ। এর আগে, জাতীয় বাজেটের ২২-২৩ অর্থবছরে এই কর দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়।
একই সঙ্গে কারখানাগুলোতে অব্যাহত বিদ্যুৎ সংযোগ ও গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ চেয়েছে সংগঠনটি। সেইসঙ্গে, রপ্তানি পরিস্থিতি ত্বরান্বিত করার জন্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়াগুলো সহজীকরণ, বিশেষ করে কাস্টম, বন্দর এবং বন্ড সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো আরও সহজ করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
নতুন বাজার খুঁজছে বিজিএমইএ:
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ইন্ডিয়ার বেশ কয়েকটি রুটে পণ্য রফতানিতে ট্রানজিট সুবিধা পাওয়ায় আগের তুলনায় আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ হবে বলে মন্তব্য করছেন ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, এর আগে আমরা শ্রীলঙ্কার কলম্বো পোর্ট ব্যবহার করে পণ্য শিপমেন্ট করেছি। এখন নতুন এই ট্রানজিট উন্মোচিত হওয়ায় আমরা নতুন বাজার খুঁজছি। যেহেতু আমরা ফাস্ট ফ্যাশন নিয়ে কাজ করি, সে কারণে আমাদের সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একইসঙ্গে রপ্তানি পণ্যের ধরনেও পরিবর্তন আনতে চাচ্ছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। বলা হচ্ছে, অধিকতর মার্কেটিংয়ের কথাও। এ লক্ষ্যে ‘মেইড ইন উইক’ নামে সপ্তাহব্যাপী দেশীয় তৈরি পোশাকের প্রদর্শনী ও এ শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন কর্মশালা নিয়ে একটি আয়োজন হতে যাচ্ছে আগামী ১২ নভেম্বর থেকে।
বর্তমানে ৭২-৭৫ শতাংশ কটনের পণ্য রপ্তানি হলেও, এর পাশাপাশি মন্ডেড ফাইবারের গার্মেন্ট বিক্রি বাড়াতে চায় তারা। ২০২১ সালে মোট রপ্তানির ৭ শতাংশ ছিল মন্ডেড ফাইবার। ‘২২ সালে এসে সেটি ৮ শতাংশ এবং ২৩ সাল নাগাদ এটি ১০ শতাংশে উন্নীত করতে চায় বিজিএমইএ।
অন্যদিকে, পুরনো বিশ্বস্ত বাজারে ইউরোপে ক্রয়াদেশ স্থগিত হওয়ায় নতুন বাজার খুঁজছে বিজিএমইএ। ইতোমধ্যে জাপানে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে। পাশাপাশি ইন্ডিয়া এবং কোরিয়াতেও সমপরিমাণ রপ্তানি করার আশাবাদ তাদের। দ্রুত শিপমেন্ট, কম্পিটেটিভ লেবার এবং গ্রিন ফ্যাক্টরির মতো সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন বাজার প্রসারিত করার চেষ্টা চলছে।
কেন ‘সংকট’ বলা হচ্ছে ও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা:
চলমান সংকট কাটাতে এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি ক্রেতা দেশগুলোতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার দাবি সংশ্লিষ্টদের। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ বছর মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। ফলে এই খাতে এখন পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে এর প্রভাব পুরো অর্থনীতিতেই পড়বে। কেননা ‘নগর পুড়িলে দেবালয় এড়ায় না’।