কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের আলোচিত ভয়ঙ্কর অপরাধ গুম। বর্তমানে গুমের মতো অপরাধ উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। চলতি বছরের সাত মাসে গুম হয়েছেন মাত্র দুই জন। এর মধ্যে একজন ফিরে এসেছেন। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করা হয়েছে গুমের মতো অপরাধ। গুমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার মতো ঘৃণ্য চেষ্টা করছে একশ্রেণীর রাজনীতিক। গুমের ঘটনা যখন কমে এসেছে, তখন এটাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের দাবি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সাল থেকে গুমের ঘটনা ক্রমাগত কমেছে। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ২ জন। এদের একজন ফিরে এসেছেন। অন্যজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গুম শুধু মানবাধিকারের বিষয়ই নয়, এটা ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধ। যেই পরিবার থেকে গুম হয় তাদের পরিবারের জন্য এটা মারাত্মক বিপর্যয়। তবে যেই অর্থে গুম শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে তার সব ঘটনাই গুম নয়। কোনটা স্বেচ্ছায় নিখোঁজ, আবার কোনটা হত্যাকান্ডের মতো ভয়াবহ অপরাধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পালিয়ে বেড়ানোর মতো ঘটনায়ও গুম শব্দ ব্যবহৃত হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।
তবে গুমের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরে আসার পর আবার আলোচনায় এসেছে গুম বা জোরপূর্বক অন্তর্ধান প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ থেকে ফিরে মিশেল ব্যাচেলেট তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে যেসব দেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তবে সেগুলোর মধ্যে নেই বাংলাদেশ। এর পর থেকেই এখন গুমের রাজনীতির ইস্যু সরব।
গুমের ঘটনাগুলোকে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকীকরণ করার জন্য জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছে, যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার শামিল। গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করার প্রাধান্য দেয়ার চেয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে হলেও রাজনৈতিক ফায়দা লোটাই মূল উদ্দেশ্য- এমনটাই উঠে এসেছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে।
দেশের মানবাধিকার বিষয়ে বেসরকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল (২৫ আগষ্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী গ্রেফতার দেখিয়েছে ৮৯ জনকে। ফেরত এসেছে ৫৭ জন। বাকিদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
আসকের তৈরি করা প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৬ সালে গুমের শিকার হয়েছিলেন ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৬০ জন, ২০১৮ সালে ৩ জন, ২০১৯ সালে ১২ জন, ২০২০ সালে ৬ জন ও ২০২১ সালে ৭ জন। আর ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ২ জন। এদের মধ্যে ২০১৯ সালে যে ১৩ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ৪ জন ফিরে এসেছেন, একজনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী এবং নিখোঁজ আছেন ৮ জন। ২০২০ সালে যে ৬ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, দুজন এখনও নিখোঁজ।
২০২১ সালে যে ৭ জন গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের ৬ জনকে পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একজন এখনও নিখোঁজ। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত যে দুজন গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের একজনকে আটক অবস্থা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছেন অন্যজন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক কর্মকর্তা বলেছেন, গত ১০ বছরের রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই, অনেক সময় গুম বেড়েছে, ক্রসফায়ার কমেছে। আবার ক্রসফায়ার বেড়েছে, গুম কমেছে। এ রকম একটা গ্রাফ দেখা যায়। মেজর সিনহা হত্যার পর বেশ কয়েক মাস ক্রসফায়ার বা গুমের ঘটনা এক-দুটার বেশি হয়ন। পরবর্তী সময়ে যে মাত্রায় ঘটে, তাই ঘটছে।
গত ডিসেম্বরের ১০ তারিখে স্যাংশন (ভিসা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ) দেয়ার পর আমরা লক্ষ্য করছি সংখ্যাটা কমে এসেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৭৬ জন গুমের বিষয়ে একটি তালিকা দিয়ে তথ্য চেয়েছিলেন। এছাড়া আরও কিছু প্রশ্ন দিয়েছিলেন তিনি, যেগুলো নিয়ে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশে আসার পর মায়ের ডাকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাদের কথা শুনেছেন। আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, আমরা ব্যাচেলেটকে গুম হওয়া ৬১৯ জনের একটি তালিকা দিয়েছি। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে গত ১৪ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গুম ও অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘আমাদের ৭৬ জনের মিসিং বা ডিজএ্যাপিয়ার্ড পার্সনের তালিকা দেয়া হয়েছিল। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, এ ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জন তাদের বাড়িতেই আছেন। দুজন আছেন জেলখানায়।
সুপ্রীমকোর্টের এক আইনজীবী বলেছেন, গুম এক ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধ। এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হলে কমে আসবে। গুম হওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করার প্রাধান্য দেয়ার চেয়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে ফায়দা লোটার প্রবণতাটাই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গুমের মতো অপরাধের ঘটনা নিয়ে সরকার বা সরকারী দল কিংবা বিরোধী দল রাজনৈতিক উদ্দেশে গুমের ঘটনাকে ব্যবহার করাটাও আরেক ধরনের অপরাধ।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, সরকার বরাবর বলে আসছে, যেসব ঘটনাকে গুম হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তার অনেক ঘটনাই স্বেচ্ছা অন্তর্ধান, যাদের অনেকে ফিরেও এসেছেন। গুম হওয়ার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের ঘটনা নিয়ে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থা।