কাজিরবাজার ডেস্ক :
হবিগঞ্জের লাখাই থানার বামই গ্রামের রাকেশ সরকারের ছেলে স্বপন সরকার। বয়স ১৮ পার হয়েছিল কদিন আগে। ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট স্বপন পেশায় ছিলেন রুটির কারিগর। ওমানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভিসা পেতে দেরি হওয়ায় বসে ছিলেন না। মেডিক্যাল পরীক্ষার টাকা জোগাড় করতে কাজ নিয়েছিলেন পুরান ঢাকার চকবাজারের কামালবাগের দেবী দাস ঘাট এলাকার ‘বরিশাল হোটেল’ নামের রেস্তোরাঁয়। কিন্তু স্বপনের আর ওমান যাওয়া হলো না। সোমবার (১৫ আগষ্ট) দুপুর ১২টায় রেস্তোরাঁয় লাগা আগুনে অন্য পাঁচ কর্মচারীর সঙ্গে মারা যান তিনিও।
প্রতিদিনের মতো রবিবারও (১৪ আগষ্ট) রাতভর কাজ করেছিলেন স্বপন। ইচ্ছে ছিল পরের দিন গ্রামের বাড়ি ফিরবেন। তার পরদিন করাবেন মেডিক্যাল পরীক্ষা। মঙ্গলবার তার মেডিক্যাল পরীক্ষা হলো ঠিকই। তবে তা হয়েছে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গে।
স্বপনসহ মারা যাওয়া অন্যদের স্বজনরাও ছিলেন সেখানে। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ময়নাতদন্তের পর স্বজনরা বাড়ি নিয়ে যায় স্বপনের মরদেহ।
মিটফোর্ড হাসপাতালের হিমঘরের সামনে কথা হয় স্বপনের বড় ভাই সজল সরকারের সঙ্গে। ভাইকে হারিয়ে বিলাপ করছিলেন। ফোনে কোনও এক স্বজনকে বলছিলেন, ‘মারে কী জবাব দিবো? ভাইয়ের তো মেডিক্যালের ডেট ছিল। আমরা শেষ হইয়া গেলাম।’
জানতে চাইলে সজল বলেন, ‘স্বপনের ওমান যাওয়ার কথা ছিল কদিন পর। সব কাগজপত্র তৈরি ছিল। ও বলছিল কাল-পরশু মেডিক্যাল করাবে। মেডিক্যাল শেষেই উড়োজাহাজে চড়ার কথা ছিল আমার ভাইয়ের।’
সজল আরও জানান, রবিবার রাতে কাজ শেষে সকাল ৮টার দিকে ঘুমাতে যান স্বপন। তার আগেও সজলের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ঘুম থেকে উঠেই বাড়ি ফেরার কথা ছিল স্বপনের।
পঙ্গু বাবা-মায়ের সম্বল পুড়লো আগুনে
কুমিল্লার চান্দিনার তিরচরের কিশোর শরীফ (১৫)। এই বয়সে পড়াশোনা আর বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধূলায় মেতে থাকার কথা। কিন্তু ভাগ্যে লেখা ছিল ভিন্ন গল্প। মাত্র ১৫ বছর বয়সে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল সংসারের হাল।
এক বোন ও বাবা-মাকে নিয়ে শরীফের পরিবার। বাবা গাছ থেকে পড়ে পঙ্গু হয়ে আছেন। তার দিন কাটে বিছানায়। মা কিডনি রোগী। অসহায় বাবা-মায়ের একমাত্র ভরসা ছিল শরীফ।
পরিচিত একজনের মাধ্যমে রোজ ৪০০ টাকা বেতনে কাজ নেয় বরিশাল হোটেলে। কিন্তু নির্মম ভাগ্য কেড়ে নিলো পঙ্গু বাবা-মায়ের সেই সম্বল। রবিবার রাতভর ডিউটি শেষে অন্য পাঁচ সহকর্মীর সঙ্গে হোটেলের ওপর তলায় ঘুমাতে যায় সে-ও। দুপুরে গ্যাসের লাইন থেকে লাগা আগুনে ঘুমন্ত শরীফ চলে যায় চিরঘুমের দেশে।
আগুনের খবর পেয়ে দুপুরে শরীফের খোঁজে আসেন মামা আরিফ ও নানী সালমা বেগম। নাতির সন্ধান না পেয়ে বরিশাল হোটেলের সামনে আহাজারি করতে থাকেন সালমা।
শরীফের মামা আরিফ বলেন, শরীফ নাইট ডিউটি করে ঘুমিয়েছিল। আগুন লাগার খবর শুনে তার নম্বর বন্ধ পেয়ে আমরা চলে আসি। এসে দেখি আমার ভাগনে মারা গেছে।
উদ্ধার হওয়া মরদেহ চেনার উপায় নেই বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা সদরের জোন ১-এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. বজলুর রশিদ।
তিনি বলেন, ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনের শরীর এমনভাবে পুড়েছে যে চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। হাড় বেরিয়ে গেছে। আরেক জনের চেহারা দেখলে কিছুটা বোঝা যায়। প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা, আগুন লাগার সময় তারা ঘুমন্ত ছিলেন।
বরিশাল হোটেলের আগুনে মারা যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন-স্বপন সরকার (১৮), ওসমান (২৫), বিল্লাল (৩৫), মোতালেব (১৬), শরীফ (১৫), রুবেল (২৮)। এরা সবাই বরিশাল হোটেলেরই কর্মী ছিলেন।
মারা যাওয়া সবার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় হোটেলের মালিক ফখরুদ্দিনকে পুলিশ তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।