কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল বত্রিশ নম্বর বাড়িটির প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। কী বীভৎসতা! গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছে ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর লাশ। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তার ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিড়িসংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্টশিশু শেখ রাসেলের লাশ।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত খুনীদের এমন নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের এমন ভয়াল বিভৎসতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি। তিনি ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাযজ্ঞের পর বঙ্গবন্ধুসহ ১৮ জনের লাশ তিনটি বাড়ি ও হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো দাফন করার এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেদিনের সেই ভয়াল বীভৎস স্মৃতিতে আনলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকষ্ট খুনীও বোধ হয় আঁতকে উঠবে।
বাংলার ইতিহাসে আজ সেই কালো দিন। ১৫ আগষ্ট, জাতীয় শোকের দিন। বাংলার আকাশ-বাতাস আর প্রকৃতিও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। কেননা, পঁচাত্তরের এই দিনে আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে। বৃষ্টিঝরা শ্রাবণের অন্তিম দিনে সেদিন বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল রক্ত।
পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। তাই ১৫ আগষ্ট শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস।
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা, গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা/ রক্তগঙ্গা বহমান/ নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/ জয় শেখ মুজিবুর রহমান।’ শোকের দিবসে আজ সারাদেশের পথে-প্রান্তরে লাখো-কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালীর কণ্ঠে ধ্বনিত হবে প্রখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘জয় মুজিবুর রহমান’ নামক কবিতায় জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এই পঙক্তিমালা।
সেদিন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসগৃহে, বত্রিশ নম্বরের সেই বাড়িতে, আমাদের ইতিহাস তীর্থে, পতিত হয়েছিলেন কেবল তার নশ্বর শরীর নিয়ে, কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্বকে বিনাশ করে। বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। কেননা, একটি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্থপতি তিনিই। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি।
সমগ্র জাতিকে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রস্তুত করেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাই চিরঞ্জীব তিনি এ জাতির চেতনায়। বঙ্গবন্ধু কেবল একজন ব্যক্তি নন, এক মহান আদর্শের নাম। যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল গোটা দেশ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে দেশের সংবিধানও প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি, হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। শোষক আর শোষিতে বিভক্ত সেদিনের বিশ্ববাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন শোষিতের পক্ষে।
দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে এই আমরাই তো একমাত্র জাতি, যারা সশস্ত্র সংগ্রাম করে, প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি একটি মানুষের ডাকে, একটিমাত্র রণমন্ত্র কণ্ঠে ধারণ করে। সেই মানুষটি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ আর সেই রণমন্ত্র ‘জয় বাংলা’। কার সাধ্য এ জাতির গতি রোধ করে, যখন এ জাতির উদ্গাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মতো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির এক সন্তান আর যখন তার বাহুতে আজও বঙ্গবন্ধুরই শক্তি রয়েছে বহমান। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সমনাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে হায়েনার দল বাংলাদেশকেই হত্যা করতে চেয়েছিল, মুছে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধজাত এই দেশটিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু এত সহজেই কি মোছা যায়- পিতার নাম আর পিতার স্বপ্নজাত দেশটিকে?
তাই আজ সেই অন্তিম শোকার্দ্র বাণী পাঠের দিন। সত্যিই আজ যে কাঁদারই দিন। আজ রক্তঝরা ১৫ আগষ্ট। বেদনাবিধূর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর দিন। বিভিন্ন কবির অসংখ্য কবিতার পঙক্তিতে উঠে আসা সেই ধন্য পুরুষ স্বাধীন বাংলার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী। বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। কলঙ্কমুক্ত বাঙালী জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন এ দেশের মানুষকে। বিশ্বাস করতেন অন্ধভাবে। কারণ, এ বাঙালীর মুক্তি, স্বাধীনতার জন্য তিনি জীবনের ২৩টি বছর ধরে লড়াই করেছেন, জীবন-যৌবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন বারংবার। কিন্তু বাঙালীর মুক্তির প্রশ্নে কোনদিন আপোস করেননি। সেই বাঙালির হাতেই তাকে পুরো পরিবারসহ জীবন দিতে হবে, এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাবনারও অতীত। কিন্তু সেটাই হয়েছে। বাঙালি নামক কিছু বিশ্বাসঘাতক-বেঈমান-হায়েনাদের হাতেই তাকে শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয়েছে।
বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দরিদ্র-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল। একজন প্রকৃত নেতার যে সব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, তার সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ। যার রাজনৈতিক জীবন ছিল বহুবর্ণিল, যার কণ্ঠে ছিল জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস।
এত কিছুর পরও শেষ পর্যন্ত তাকে জীবন দিতে হয়েছে ঘাতকের হাতে। ৪৭ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই কালিমাময় দিনে জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে। একাত্তরের পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য সর্বনাশা চক্রান্তে একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজন। রচিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু তাতে তো এমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে একটি জাতির হৃদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন প্রতিটি উৎসবে, আনন্দ-বেদনায়।
রাজনীতির সঙ্গে সামান্যতম সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও নারী-শিশুরাও সেদিন রেহাই পায়নি ঘৃণ্য কাপুরুষ এই ঘাতকচক্রের হাত থেকে। বিদেশে থাকার জন্য প্রাণে বেঁচে যান কেবল বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দিনটি তাই বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত। জাতীয় শোক দিবসে আজ বাঙালি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ পালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী।
বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালি জাতিকে ৩৫টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রতি পদে পদে খুনীদের দোসর ও মদদদানকারী সরকারের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ২০১০ সালের শুরুতেই ২৮ জানুয়ারি মানবতার শত্রু নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনী আবদুল মাজেদকে দেশে গ্রেফতারের পর আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ছয় খুনীর ফাঁসি হলেও আজও নেপথ্যের কুশীলবরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাঁচ বঙ্গবন্ধুর খুনী এখনও রয়েছে পলাতক।
৪৭ বছরের পথপরিক্রমায় জিয়াউর রহমানসহ অনেকের নামই এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও আইনগতভাবে তাদের কিছুই করা হয়নি। তাই এবারের শোক দিবসের সর্বত্র একই আওয়াজ- শুধু খুনী নয়, নেপথ্যের কুশীলবদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। একটি বিশেষ জাতীয় কমিশন গঠন করে জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও নেতাদের মুখ থেকেও এ দাবি উঠেছে বেশ জোরের সঙ্গেই। সরকার থেকেও দ্রুতই এই কমিশন গঠনের ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে।
কী ঘটেছিল সেই সর্বনাশা কৃষ্ণ দিনে : অকুতোভয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট নারকীয় হামলার সময় ঘাতকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও খুনীদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন- ‘তোরা কি চাস? আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি?’ বঙ্গবন্ধুকে দেখেও হাত কাঁপেনি বেঈমান-মোনাফেক খুনীদের। বঙ্গবন্ধুর রক্তের কেউ যেন বেঁচে না থাকে, সেভাবেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে খুনীর দল।
বঙ্গবন্ধুর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে এই ভূখন্ডের মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। আমরা পেয়েছিলাম নিজস্ব জাতি রাষ্ট্র, গর্বিত আত্মপরিচয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস কারাগারে বন্দী রেখেও পাকিস্তানী জল্লাদরা বঙ্গবন্ধুর কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করার সাহস দেখাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল স্বাধীন দেশে কোন বাঙালী তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনের পরিবর্তে থাকতেন তার প্রিয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির অপরিসর নিজ বাসভবনেই।
বাঙালির স্বাধীকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এই বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী ছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসীম ও গভীর ভালোবাসা ও বিশ্বাসকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। রাতের অন্ধকারে হামলায় চালায় স্বাধীনতার স্থপতির বাসভবনে। কারুপুরুষোচিত আক্রমণ চালিয়ে পৈশাচিক পন্থায় ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালিকে পিছিয়ে দেয় প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রমিছিল থেকে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে নরপিশাচ ঘাতকের দল শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নির্মমভাবে হত্যা করেনি, মেতে উঠেছিল অদম্য রক্তপিপাসায়। কিছু বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর রাজনীতিকের চক্রান্ত, পরাজিত পাকিস্তানী দোসরদের পরিকল্পনা এবং সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী উচ্চাভিলাষী সদস্যরা পৈশাচিক কায়দায় গুলি করে সেদিন বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, একসঙ্গে তিন বাড়িতে হামলা করে মেতে উঠেছিল ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে।
নিষ্ঠুর কায়দায় একে একে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর অনুজ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি পানি সম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবি সেরনিয়াবত, আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী। লুঙ্গিতে জড়ানো শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনীদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা পায় না মানবতাবাদী বিশ্বের কোন মানুষ।
রাজনৈতিক হত্যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন কাল পরিসরে। কিন্তু প্রতিটি হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে? এখানে ইতিহাস যেন উল্টো পথযাত্রী! এখানে বিচার বিঘ্নিত। বিশ্বের ইতিহাসে একসঙ্গে এত নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের নজীর নেই বললেই চলে। তবুও কী আশ্চর্য, এই ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত আত্মস্বীকৃত খুনীদের চূড়ান্ত শাস্তি পেতে কেটে যায় একে একে ৩৪ বছর। বিচারের পথে সৃষ্ট দীর্ঘ বাধার প্রাচীর বিতর্কিত করে দেশের সুপ্রীমকোর্ট এবং বিচারপতিদেরও। জাতি দেখেছে এই দীর্ঘ সময়ে নিষ্ঠুর এই ঘাতকদের প্রকাশ্য পুরস্কৃত করার ঘৃণ্য চিত্র।
সেই বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে অবশেষে বিচারের বাণীর নিভৃত কান্নার অবসান ঘটে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মধ্য রাতের পর। ২৮ জানুয়ারি ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকর হয় পাঁচ আত্মস্বীকৃত খুনীর। কলঙ্কমুক্তির আনন্দে উদ্বেল হয় গোটাদেশ। তবুও জাতির খুনীদের প্রতি ঘৃণা এতটুকুও কমেনি। অনেকেরই জিজ্ঞাসা- ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলেও এসব ঘৃণ্য নরপশুদের প্রতি বাঙালির ঘৃণা-ধিক্কার এতটুকুও কমবে না। বরং দেশ যতদিন থাকবে, ততদিন এসব ঘাতকদের কবরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের সন্তানরা তাদের হৃদয়ের ঘৃণা জানাতে এতটুকুও ভুলবে না।
নানা কর্মসূচীতে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ : রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ সোমবার পালিত হবে জাতীয় শোক দিবস। এ উপলক্ষে ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডি ও টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার প্রাঙ্গণ ও এর আশপাশের এলাকায় নিñিদ্র নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে মহান আল্লাহর দরবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সরকারী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সশস্ত্রবাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। সকাল সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে জাতির পিতার পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য শহীদদের কবরে প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক ও ফুলের পাপড়ি অর্পণের পর ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করা হবে।
এ ছাড়া আজ সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। সশস্ত্রবাহিনীর গার্ড অব অনার ছাড়াও সমাধি কমপ্লেক্সে ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত করা হবে। শোক দিবসে সারাদেশের মসজিদসমূহে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আজ সকল সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারী ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া শোক দিবস উপলক্ষে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর পোস্টার প্রকাশ করেছে। সারাদেশে গণযোগাযোগ অধিদফতর বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করবে। সকল সরকারী-বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলোচনা সভা, কবিতা পাঠ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্র প্রদর্শনী, হামদ-নাত প্রতিযোগিতা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবে। ধানমন্ডি, বনানী ও টুঙ্গিপাড়ার অনুষ্ঠান বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হবে। এ ছাড়া অন্যান্য বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম বেতার ও কমিউনিটি রেডিও অনুষ্ঠানসমূহ সরাসরি সম্প্রচার করবে।
দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সূর্য উদয়ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। সকাল ৮টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল। দুপুর ১২টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। উক্ত কর্মসূচীতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল, গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। বাদ জোহর কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। একইভাবে দেশব্যাপী মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। দুপুরে সারাদেশে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থদের মাঝে খাদ্য বিতরণ ও গণভোজের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও, ১৬ আগষ্ট বিকেল সাড়ে ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন।
এ ছাড়া দেশব্যাপী অজস্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিস্তারিত কর্মসূচীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। আওয়ামী লীগ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিস্তারিত কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করছে জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী।