স্টাফ রিপোর্টার :
সিলেটে বন্যা ভয়াবহতা কখন থামবে, কখন শেষ হবে, তা যেন কারোরই জানা নেই। কখনো পানি কমে, কখনো বাড়ে, আবার কখনো অপরিবর্তিত থাকে। দিনভর প্রখর রোদ থাকে আকাশে, রাতে হঠাৎ নামে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। এতে হাওর-বাওর ও নদী-নালার পানির পরিমান প্রায় একই থাকে। গত মঙ্গলবারও সিলেটের ২ প্রধান নদী সুরমা-কুশিয়ারার পাঁচ পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হয়। এতে বন্যা আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মানুষের প্রহর কাটছে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা আর ভয়ে।
ঈদের আর মাত্র ৩ দিন বাকী। অথচ সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ ঈদের এই আনন্দঘন সময়ে লড়ছে পানির সাথে, জীবনের সাথে। সব জায়গায়ই বিরাজ করছে হাহাকার। কাজ নেই, কর্ম নেই। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ছাড়া প্রায় সব শ্রেনীর মানুষের এখন ভরসা বেসরকারী ত্রাণ কিংবা সরকারী সহায়তা। প্রশ্ন জাগছে, এসব সহায়তা কি মেটাতে পারছে তাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন চাহিদা?
স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছেন, শহরকেন্দ্রীক গ্রাম কিংবা এলাকাগুলোতে মানুষ ত্রাণ সহায়তার নাগাল পাচ্ছে ঠিক। কিন্তু একেবারে অজোপাড়া গ্রামের অসহায় মানুষগুলো পর্যাপ্ত সহায়তার দেখাই পাচ্ছেনা। ফলে উপোষ করে, খেয়ে না খেয়ে এক একেকটা ভয়াল দিন পার করছেন এসব মানুষগুলো। বন্যায় এদের ঘরের সবকিছু ভেসে গেছে। চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে তাঁদের সাজানো স্বপ্ন। বানভাসী লাখ লাখ মানুষের নেই কোন ঈদ ভাবনা।
গত মঙ্গলবার সিলেট-সুনামগঞ্জের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বানভাসি মানুষের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কোথাও ঘর ধসে পড়েছে, আবার কোথাও ঘরের বেড়া নেই। ভয়াল বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে শত শত গরু, ছাগল, হাস মুরগি। এসবের ওপর ভরসা করে এবার ঈদুল আজহা উদযাপনের চিন্তা ছিল বেশির ভাগ বানভাসি মানুষের। কিন্তু বন্যায় সবকিছু হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা। কোনরকম বেঁচে আছেন আশ্রয়কেন্দ্রে আবার কেউবা আত্মীয়ের বাড়ীতে, আবার অনেকে রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতেই।
এদিকে, সিলেট জেলার প্রায় অধিকাংশ এলাকা এখনো পানির নিচে। বিশেষ করে বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ এলাকার অর্ধেকের বেশী গ্রাম এখনো পানির নিচে। এখনো ঘরছাড়া হাজার হাজার মানুষ। এই চিত্র সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলারও। এখনো জেলার নিম্নাঞ্চলের অনেক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যার ভয়াবহতা দেখে গত মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রীও অক্ষেপ করে বলেছেন, গত ৩০ বছরের নির্মাণকৃত গ্রামীণ সড়ক শেষ হয়ে গেছে। নিজের ভিটায় যেতে পারছেন না হাজারো পরিবার। এসব মানুষদের ছোট ছোট বসতঘর নির্মাণ করে দিতে হবে। মঙ্গলবার সুনামগঞ্জে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখলাম। এরকম বন্যায় কিছুই থাকে না, এখানেও তাই হয়েছে।
সত্যিই তাই, সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যায় লাখ লাখ মানুষের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। কেবল কোনমতে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে বেঁচে আছে এসব মানুষের প্রাণ।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সিলেটে এখনো ২ নদীর পাঁচ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমার কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমা ১২ দশমিক ৭৫। মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ওই পয়েন্টে পানি ছিলো ১৩ দশমিক ০৭ সেন্টিমিটার। সুরমার ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমা ৮ দশমিক ১১। মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় ওই পয়েন্টে পানি ছিলো ৮ দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার।
কুশিয়ারা আমলশিদ পয়েন্টে বিপদসীমা ১৫ দশমিক ৪০। মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় ওই পয়েন্টে পানি ছিলো ১৬ দশমিক ১৯ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমা ১৩ দশমিক ০৫। ওই মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় ওই পয়েন্টে পানি ছিলো ১৩ দশমিক ২৪ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমা ৯ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় ওই পয়েন্টে পানি ছিলো ১০ দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার।
সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, সিলেট থেকে পানি সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওর হয়ে নামে। তবে সুনামগঞ্জে পানি বেশি থাকায় ধীরগতিতে নামছে।
এদিকে, গত ৩ দিনের মতো মঙ্গলবারও ছিলো রৌদ্রজ্জ্বল দিন। তবে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার ভোররাতে বৃষ্টি হয়েছে খুব। এতে প্রচন্ড গরমের মাঝে একদিকে যেমন স্বস্তির হাওয়া বয়ে যায়, অন্যদিকে লাখো মানুষের মাঝে পানি বৃদ্ধিরও শঙ্কা দেখা দেয়।
এদিকে, মঙ্গলবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সুরমা নদীর পানি উপচে খাল ও ছড়া হয়ে যেসব এলাকায় আগে প্রবেশ করেছিল, সেই এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। বাসাবাড়ি থেকেও পানি নেমে গেছে। তবে কয়েকটি মহল্লার সড়কে এখনো পানি রয়েছে। নগরীর শাহজালাল উপশহর এলাকার ডি ব্লকের ভেতরেও পানি জমে আছে। এ ছাড়া উপশহরের সি ও এ ব্লকে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। নগরীর তেররতন এলাকায় পানি নেমে গেলেও অনেকের বাসাবাড়ি স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকর এলাকার কিষণপুরের মানুষ এখন পানিবন্দি রয়েছেন। এ পাড়ার বন্যার পানি নামছে ধীরগতিতে। তবে প্রতিদিনের মতো গতকাল বুধবার ভোর রাতে বৃষ্টি হওয়াতে পানি বেড়ে গেছে আরো আধাহাত।