কাজিরবাজার ডেস্ক :
১৯২০ সালের পর সোভিয়েত অঞ্চলে কমিউনিস্টদের অন্যতম একটি স্লোগান ছিল ডনবাস নিয়ে, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘রাশিয়ার হৃৎপিণ্ড ডনবাস’। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর নব্বইয়ের দশকে এলাকাটি যখন ইউক্রেনের হয়, তখন সেখানকার বিভিন্ন শহরে ‘ইউক্রেনের হৃৎপিণ্ড ডনবাস’ লেখা বড় বড় হোর্ডিং টাঙানো হয়েছিল, যার কিছু আজও চোখে পড়ে।
লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক- এ দুই প্রদেশের সমন্বয়ে ইউক্রেনের পূর্বের এই অঞ্চলটি ইউক্রেন বা রাশিয়ার হৃৎপিণ্ড হোক বা না হোক, সেটি এখন এ দুই দেশের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের হৃৎপিণ্ড বা কেন্দ্রবিন্দু, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পরপরই ডনবাস অঞ্চলটি তথাকথিত ‘নব্য নাৎসিদের’ হাত থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দেয় মস্কো। এমনিতেই ২০১৪ সাল থেকে রুশপন্থি বিদ্রোহীরা ডনবাসের প্রায় অর্ধেকটা নিয়ন্ত্রণ করছে। এখন পুরো অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে রাশিয়া।
লুহানস্ক প্রদেশের সবশেষ যে শহরটি ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল, গত রোববার সেই লিসিচানস্কেরও দখল নিয়েছে রাশিয়া। পর্যবেক্ষকদের মতে, রুশ বাহিনীর এখন মূল লক্ষ্য ডনবাসের অন্য প্রদেশ দোনেৎস্ক থেকে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের তাড়ানো।
এর লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট। কারণ, দোনেৎস্কের প্রধান দুই শহর- স্লোভিয়ানস্ক ও বাখমুটে রোববার থেকে তীব্র আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়া। দোনেৎস্কের অর্ধেক এলাকা এরই মধ্যে তাদের দখলে।
দোনেৎস্ক রাখতে পারবে ইউক্রেন?
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে রাশিয়া যেভাবে পূর্ব ও দক্ষিণে ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তাতে অনেক বিশ্লেষকই সন্দেহপ্রকাশ করছেন, দোনেৎস্কের শহরগুলোতে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা কতটা প্রতিরোধ গড়তে পারবে অথবা আদৌ পারবে কি না।
রাশিয়ার বর্তমান কৌশল দেখে এটি পরিষ্কার, যুদ্ধের শুরুর দিকের ব্যর্থতা থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে এবং এখন খুব সাবধানে এগোচ্ছে। রাশিয়া এখন টার্গেট করা এলাকাগুলোতে প্রথম কয়েকদিন দিন-রাত প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের দিশেহারা করে ফেলছে। তারপর ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে রুশ সৈন্যরা শহরগুলোতে ঢুকে নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে।
দোনেৎস্কের শহরগুলোতেও রাশিয়া একইভাবে সফল হবে? নাকি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা সেখানে শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করবে? যদি না পারে এবং রাশিয়া যদি সত্যিই পুরো ডনবাস দখল করে নেয়, তাহলে এই যুদ্ধ কোন দিকে গড়াবে এবং তাতে ইউক্রেনের পরিণতি কী হবে?
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তার সরকারের কর্মকর্তারা একাধিকবার বলেছেন, ডনবাসে লড়াইয়ের ফলাফলের ওপর পুরো যুদ্ধের পরিণতি নির্ভর করছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ডনবাসে রাশিয়া যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করছে এবং তাতে যে প্রাণহানি হচ্ছে, তাতে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোডলিয়াক সম্প্রতি বলেছেন, ডনবাসে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ ইউক্রেনীয় সৈন্য প্রাণ হারাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা এই সংখ্যা আরও বেশি হবে।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজেও ডনবাসে মোতায়েন সৈন্যদের বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। লিসিচানস্ক শহর থেকে সৈন্যদের নিরাপদে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তের পেছনে তিনি প্রাণহানি কমানোর লক্ষ্যের কথা বলেছেন।
যুদ্ধ শুরুর আগে ডনবাসে ইউক্রেনের ৪৪ হাজার সৈন্য মোতায়েন ছিল এবং এরা দেশটির সেনাবাহিনীর সবচেয়ে প্রশিক্ষিত, পেশাদার এবং দক্ষ ইউনিটগুলোর সদস্য। এদের হারালে এবং যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে নতুন করে সেনা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কঠিন হবে, যা নিয়ে ইউক্রেন উদ্বিগ্ন।
দোনেৎস্ক প্রতিরোধের লড়াইতেও ইউক্রেনের সেনা কমান্ডাররা সৈনিকদের প্রাণরক্ষার কথা কতটা বিবেচনা করবেন, তার ওপরও ডনবাসের যুদ্ধের পাল্লা কোন দিকে হেলবে তা অনেকটা নির্ভর করবে।
পুতিন কি ডনবাসেই থামবেন?
রাশিয়া এখন ইউক্রেনের কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর মারিউপোলসহ আজভ সাগরের পুরো উপকূল নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্রিমিয়ার কাছে খেরসন বন্দরসহ পুরো খেরসন এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে। অথনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাপোরিঝিয়ার বিশাল অংশও এখন রাশিয়ার দখলে।
ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের ধারণা, ডনবাস দখল করতে পারলে পুতিন হয়তো সেখানেই থামবেন না। তিনি যদি দেখেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনী অনেক শক্তি হারিয়েছে, তাহলে আরও এলাকা দখলের পথে এগোবেন, যাতে ভবিষ্যতে যেকোনো আলোচনায় তার শর্ত মেনে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি এক রুশ জেনারেল খোলাখুলি বলেছেন, মিকোলাইভ ও ওডেসা হয়ে রোমানিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান তারা, যাতে মলদোভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জাতিগত রুশ অধ্যুষিত ট্রানসিসট্রিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার একটি স্থল করিডোর তৈরি সম্ভব হয়।
এর অর্থ, আজভ সাগরের পর কৃষ্ণসাগর থেকেও ইউক্রেনকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। সত্যিই যদি পুতিন সেই পথে এগোন এবং সফল হন, তাহলে সেটি হবে ইউক্রেনের জন্য দুঃস্বপ্ন।
মিলান-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইতালিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল স্টাডিজের গবেষক এলেনোরা আমব্রেসেটি আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পুরো উপকূল দখল করে ইউক্রেনের অর্থনীতিকে চরম চাপে ফেলার পথ নিতে পারে রাশিয়া, যাতে সাগর পথে ইউক্রেনীয়দের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।