কাজিরবাজার ডেস্ক :
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবার পেঁয়াজ, চাল ও মাছের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্য নিয়ে অসাধু মজুদকারী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। এমনকি কোরবানি ঈদ সামনে রেখে গরু-ছাগলের মতো গবাদিপশু নিয়েও কারসাজি করার তেমন সুযোগ নিতে পারবে না অসৎ ব্যবসায়ীরা। মাত্র ৩-৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পদ্মা সেতু পার হয়ে দক্ষিণবঙ্গের বেশিরভাগ জেলা থেকে পণ্যবাহী ট্রাক আসবে ঢাকায়। অথচ যুগের পর যুগ ধরে ট্রাক, লরি ও কাভার্ডভ্যানের পদ্মা পার হতে কয়েকদিন পর্যন্ত ফেরিঘাটে লাইন ধরে অপেক্ষা করতে হতো। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মিলত ফেরির সিরিয়াল। প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগ কিংবা অনাকাক্সিক্ষত কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আরও বিপদ নেমে আসত। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় কৃষিজাত কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যেত। অনেক সময় হাঁস, মুরগি এবং গরু-ছাগলের মতো প্রাণীর মৃত্যু হতো ঘাটেই! আর এসবের সুযোগ নিতেন ঢাকার মজুদকারী ব্যবসায়ীরা। বেড়ে যেত নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম। ভোক্তাদের কষ্ট বাড়ত। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এবার ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
জানা গেছে, ঢাকা শহরে দেশী পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা হচ্ছে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা। কুষ্টিয়ার মোকামগুলো থেকে প্রতিদিন আসে হাজার হাজার টন চাল। অন্যদিকে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বৃহত্তর বরিশাল ও বৃহত্তর খুলনা থেকে চিংড়ি ও ইলিশসহ বিভিন্ন জাতের মাছ আসে রাজধানীতে। রাজধানীসহ সারাদেশের ইলিশ যায় বরিশাল থেকে। এছাড়া অন্যান্য কৃষিজাত নিত্য ও ভোগ্যপণ্যের বড় জোগানদাতা দক্ষিণবঙ্গের একুশ জেলা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাজধানীতে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দ্রুত পেঁয়াজ, চাল এবং মাছের মতো পণ্য নিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হওয়ায় এসব ভোগ্যপণ্য নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া সেতু হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে। কমবে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ। বদলে যাবে কৃষিতে উন্নত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনমান।
খুব সহজেই স্বল্পতম সময়ে তাদের কৃষিপণ্য রাজধানী ঢাকায় চলে আসবে। যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে। এ সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকা- প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মোঃ আমিন হেলালী জনকণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে দক্ষিণ বাংলার ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকাসহ সারাদেশের সরাসরি কানেক্টিভিটি তৈরি হয়েছে। এর ফলে ওইসব জেলার উৎপাদিত ভোগ্য ও নিত্যপণ্য দ্রুত রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলায় নিয়ে আসা সম্ভব। ফলে সিন্ডিকেট মজুদকারী ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, আগে ফেরিঘাটে দিনের পর দিন পণ্যবাহী ট্রাকগুলো লাইন ধরে বসে থাকত। এতে পণ্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কর্মঘণ্টা অপচয় হতো। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যেত। কিন্তু এখন স্বল্প সময়ে উৎপাদিত পণ্য দ্রুত সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছাতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। ফলে পণ্য মজুদ করে দাম বাড়ানোর কেউ সুযোগ নিতে চাবে না। এর ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। জানা গেছে, দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চাল এবং কোরবানির গরু ও ছাগলের মতো প্রাণীর সরবরাহ হয়ে থাকে কুষ্টিয়া জেলা থেকে। এ অঞ্চলে ধান-চাল উৎপাদনের পাশাপাশি গরু-ছাগল পালনে বড় বড় খামার গড়ে উঠেছে। এবার বিপুল সংখ্যক গরু ও ছাগল আসবে কুষ্টিয়া থেকে। চাল এবং মাংসের জন্য কৃষ্টিরার ওপর ঢাকাবাসীকে নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে জাতীয় মাছ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে হলে তা আনতে হবে বরিশাল থেকে। এর বাইরে চট্টগ্রাম থেকে দেশে ইলিশ মাছের জোগান দেয়া হয়। তবে সুস্বাদু ইলিশ মেলে বরিশালে। কিন্তু কৃষিজাত এসব পণ্য দিনের পর দিন ঘাটে আটকা থাকত। ফলে ঢাকায় এসব পণ্য নিয়ে প্রায়শই কারসাজি হয়ে থাকে।
এদিকে, সর্বশেষ চাল ও পেঁয়াজ নিয়ে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছেন। এমনকি চাল মজুদের প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন। শুধু তাই নয়, বেনাপোল স্থল বন্দর কিংবা মোংলা পোর্ট হয়ে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় সেগুলো পদ্মা নদী পার হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। সেতু হওয়ার ফলে আমদানিকৃত পণ্যও দ্রুত সময়ে আনা সম্ভব হবে। এর ফলে ঢাকায় জিনিসপত্রের দাম কমার পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা বন্ধ হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের গভীরতা অনেক। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে ২১ জেলার সঙ্গে পুরোদেশের সরাসরি সংযুক্তি করেছে এই পদ্মা সেতু। এতে ওই অঞ্চলে যেসব পণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, চাল এবং মাছের মতো পণ্য এখন দ্রুত দেশে নিয়ে আসা যাবে। এর ফলে বন্ধ হবে অসাধু মজুদকারী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি। শুধু তাই নয়, পণ্যবাহী ট্রাকগুলো দ্রুত ঢাকায় আসার সুযোগ তৈরি হওয়ায় জিনিসপত্রের দামও কমে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে গেছে। পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চল ও পদ্মার দুই পাড়ের উন্নয়ন নিয়ে স্বপ্ন খেলা করছে। দক্ষিণাঞ্চল তথা বাংলাদেশের কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পদ্মা সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। পদ্মার দুই পাড়ে অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠবে। দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা নতুন নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন। বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোনে স্থাপন হবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা। নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নদীর পাশেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অলিম্পিক ভিলেজ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ-বন্দর, অভ্যন্তরীণ কন্টেনার টার্মিনাল, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন, ইকোনমিক করিডর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এছাড়া বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করেছেন।