এসএসএফের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী ॥ সতর্ক থাকুন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যেন বাধা না আসে

14
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এর ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোসহ দেশে সাম্প্রতিক বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে ‘রহস্যজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বিরোধিতাকারীরা যাতে কোন রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য সজাগ থাকার জন্য সশস্ত্র বাহিনীসহ সকল বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এত বড় একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজটা আমরা সম্পন্ন করেছি (নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু), যারা এর বিরোধিতা করেছিল তাদের কিন্তু একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। যার কিছু কিছু তথ্যও আমরা পেয়েছি যে, এমন একটা ঘটনা ঘটানো হবে যাতে ২৫ তারিখে আমরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা করতেই না পারি। কি করবে তা জানি না।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত তিন বাহিনী প্রধান, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং আনসার ও ভিডিপির প্রধানদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের সবাইকে কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। সমস্ত বিষয়টাই একটু রহস্যজনক। এজন্য সবাইকে বলব একটু সতর্ক থাকতে হবে এবং আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দিকেও সবাইকে নজর দিতে হবে সেগুলোর নিরাপত্তা দিতে হবে।
বুধবার তার কার্যালয়ের (পিএমও) শাপলা হলে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) এর ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ভুয়া দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এ দেশের ব্যক্তি বিশেষের প্ররোচনায় বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে তার সরকার ঘোষণা দিয়েছিল নিজেদের অর্থায়নে করবে, না হলে করবে না। আজকে সেই পদ¥া সেতু তার সরকার নিজেদের অর্থে নির্মাণ করেছে।
সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আপনারা দেখেছেন রেলে আগুন, লঞ্চে আগুন, ফেরিতে আগুন এমনকি সীতাকুন্ডে যে আগুনটা সেটা একটা জায়গা থেকে লাগতে পারে কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটা জায়গায় আগুন লাগে কিভাবে ? আর রেলের আগুনের বিষয়ে একটি ভিডিও পাওয়া গিয়েছে যেখানে দেখা গেছে রেলের চাকার কাছ থেকে আগুন জ¦লছে, সেটা কি করে সম্ভব সে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই জিনিসগুলো রহস্যজনক।
এসএসএফর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ মজিবুর রহমান স্বাগত ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড.আহমদ কায়কাউস এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
তার সরকার গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তিকে মানুষের নাগালের মধ্যে এনে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে তার সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস সম্পর্কেও সকলকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা যেমন একদিকে আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, অপরদিকে এই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী তাদের নানা কর্মকান্ড পরিচালিত করে থাকে।
এ কারণে তার সরকার আধুনিক বিশ্ব এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসএসএফসহ অন্যান্য বাহিনীগুলোকে প্রযুক্তি নির্ভর করে শক্তিশালীভাবে গড়ে তুলছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেননা আমাদের বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে এবং বিভিন্ন সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকেও দমন করতে হবে। অতীতে বিভিন্ন বাহিনীগুলোর গুরুতত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণেই তার সরকার জোট সরকারের আমলে সৃষ্ট সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে এবং মনে রাখতে হবে আমরা যখন এগিয়ে যাই তখনই এ ধরনের ঘটনা কোন কোন মহল ঘটনানোর চেষ্টা করে থাকে। সেটাই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের। সেজন্য সবাইকে আমি সতর্ক থাকার আহ্বান জানাব।
সরকার প্রযুক্তি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী হাইটেক পার্ক ও কম্পিউটার ল্যাব করে প্রযুক্তি শিক্ষার দিকে নজর দিয়েছে। পাশাপাশি স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে, রাজধানীবাসীর চলাচল সুবিধার জন্য মেট্রোরেল প্রকল্পও আজকে দৃশ্যমান। এছাড়া, এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে, চট্টগ্রাম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোরও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে একটা মিথ্যা অপবাদ আমাদের দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, আমাদের একজন স্বনামধন্য মানুষ, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলাম, সেই ড. ইউনূস বেঈমানী করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না পেরে তিনি এ কাজ করেছেন। তিনি তার বন্ধু তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের স্বামীর ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে’ তিন লাখ ডলার ডোনেশনও দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, হিলারি ক্লিনটন তাকে ফোনও করেছেন। অন্যদিকে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে বলে তারা বিশ্ব ব্যাংকের কাছে বার বার মেইল পাঠিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম যে, দুর্নীতির প্রমাণ করতে হবে। পরে কানাডার আদালতে এটা ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ড. ইউনূসের প্ররোচনায় বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। আমরা বলেছিলাম, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করব। কাজেই, খুব স্বাভাবিকভাবে অনেকেই ভেবেছিল এটা বোধহয় আমরা কোনদিন করতে পারব না। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমরা কিন্তু সেটা করে ফেলেছি।
একজন রাজনীতিকের কাছে জনগণই তার ‘প্রাণশক্তি’ এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কখনও যেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন, সেই বিষয়টি যারা তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তাদের বিবেচনায় রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি, ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে জোর করে দেশে ফিরে আসার পর থেকে বারংবার হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হয়ে আল্লাহর রহমতে এবং দলের নেতা-কর্মী সৃষ্ট মানবঢালে প্রাণে রক্ষা পাবার কথা স্মরণ করে তাকে নিরাপত্তা প্রদানকারীদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও তিনি নিজে সব সময় শঙ্কায় থাকেন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুলি ও বোমার মুখে পড়েছি। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। হয়ত আল্লাহ আমাকে দিয়ে কোন কাজ করাবেন, এজন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা হত্যাকা-ের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছিলেন বলেই দেশ আজ অভিশাপ মুক্ত হয়েছে এবং দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে যেসব বিদেশী অতিথিরা আসেন তারা এসএসএফের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তিনি নিজেও তাদের পারদর্শিতায় গর্ববোধ করেন বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এটাই সব সময় মাথায় রাখতে হবে পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা শৃঙ্খলা সবকিছু মেনেই চলতে হবে এবং আমাদের এসএসএফ সে ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন।
শেখ হাসিনা বলেন, তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য। জনগণের সঙ্গে একটু কথা বলা, জনগণের সঙ্গে একটু মেশা এটাই একমাত্র কাজ। এটাই আমাদের শক্তি। আর কোন শক্তি কিন্তু নেই। বিরোধী দলে যখন ছিলাম মানুষকে কি দিতে পেরেছি, একটা আস্থা বা মানুষের বিশ্বাস অর্জন। সেজন্য জনবিচ্ছিন্ন যেন না হয়ে পড়ি সেটা একটু দেখতে হবে। কারণ, পানি থেকে মাছ তুলে ডাঙায় রাখলে যে রকম আমরা যদি জনগণের সঙ্গে মিশতে না পারি তাহলে আমাদের অবস্থাও কিন্তু সে রকমই হয়ে যায়। কারণ জনগণই আমাদের প্রাণশক্তি। তাদের জন্যই আমার এ রাজনীতি।
প্রধানমন্ত্রিত্ব নিজের কাছে ভোগের কোন বস্তু নয় জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, তার বাবা অতীতে মন্ত্রী ছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন, কিন্তু তারা ৫টা ভাই-বোন কখনই ক্ষমতা ভোগ করার কথা চিন্তা করেননি। যা তাদের বাবা-মায়ের নির্দেশ ছিল। দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও তার পরিবারের সদস্যরা নিজেদের জীবন যাপনের ধরনের কোন পরিবর্তন আনেননি। আমি সব সময় যখন দোয়া করি আমি আমার ছেলে মেয়ের জন্য যেমন দোয়া করি, নাতি পুতির জন্য যেমন দোয়া করি, তেমনি ঠিক সেই রকমভাবে আমার সঙ্গে যারা কাজ করেন প্রত্যেকের জন্য আমি দোয়া করি। এসএসএফের জন্য বিশেষ করে দোয়া করি। আমার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে যেন কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা সব সময় আমি চিন্তায় রাখি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারী সদস্য নিয়োগ আমরা শুরু করি। পুলিশে নারী সদস্য নিয়োগ জাতির পিতাই শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ভৌগলিক সীমারেখায় আমরা হয়ত ছোট, কিন্তু জনসংখ্যায় বড়। আমরা বড় হয়ে চলব, বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলব। আমরা দেশটাকে সেভাবে গড়ে তুলতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে আমরা যে মর্যাদা পেয়েছি সেই মর্যাদা নিয়ে আমরা যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারি। আজকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের যে মর্যাদা পেয়েছি তা নিয়েই যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারি এবং দেশী-বিদেশী কোন শক্তিই যেন এই অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। জাতির পিতার করে দেয়া পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ এই নীতি নিয়েই বাংলাদেশ আগামীতেও সামনে এগিয়ে যাবে।