লবণে উৎপাদনে এবার রেকর্ড, চাষীদের মুখে হাসি

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সদ্য সমাপ্ত উৎপাদন মৌসুমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদন মোট চাহিদার কাছাকাছি চলে আসায় দেশের ইতিহাসে লবণ খাতে রেকর্ড গড়েছে। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে অপেক্ষাকৃত অনুকূল আবহাওয়া, রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের পক্ষ থেকে তদারকি ও নানা উদ্যোগ এবং লবণ চাষীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রাখা ও শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের শুল্কহার বৃদ্ধি করার জের হিসেবে লবণ উৎপাদন নজিরবিহীন সাফল্য এসেছে। হাসি ফুটেছে প্রান্তিক চাষীদের মুখে। বাজারজাত প্রক্রিয়ায় এসেছে গতিশীলতা। হ্রাস পাবে ভবিষ্যত আমদানি। প্রান্তিক চাষী, লবণ মিল মালিক সমিতি, বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের পরিসংখ্যানে এসব তথ্য মিলেছে। বিসিক ও বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। যা অতীত ইতিহাসের রেকর্ড। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে গত ২১ মে লবন উৎপাদন মওসুম সমাপ্ত হয়েছে। সাধারণত নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে লবন চাষীরা মাঠে নেমে যান। উৎপাদন শুরু হয় জানুয়ারির প্রথমার্ধ থেকে। প্রাকৃতিক কোন বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি না হলে তা টানা চলে মে মাস পর্যন্ত। মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজেলায় লবণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে কক্সবাজারে কুতুবদিয়ার লেমশীখালী, মহেশখালী উপজেলার উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা, মাতারবাড়ী, ঈদগাঁও উপজেলার গোমাতলী, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, পেকুয়া উপজেলার দরবেশকাটা, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফের সদর এলাকা, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনা ও সরল এলাকায় লবণের চাষ হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, চলতি বছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। মৌসুম শেষে বিসিকের হিসাবে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চাহিদার বাকি রয়েছে মাত্র ৫ লাখ টন। যা অতীতে কখনও হয়নি। গেল মৌসুমে মোট লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৮শ’ ২০ টন। এবার প্রায় ২ লাখ টন বেশি উৎপাদিত হয়েছে।
এ সাফল্যের নেপথ্যের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে মাঠ পর্যায়ের চাষী, মিল মালিক সমিতি এবং বিসিকের পক্ষ থেকে যুগপৎভাবে জানানো হয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতে চাষীদের মাঠে নামার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি উৎপাদিত লবণ নিয়ে প্রান্তিক চাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তা নিয়ে কথা দিয়েছেন। ফলে চাষীদের মধ্যে সাড়া পড়ে ব্যাপক। এ ছাড়া লবণ মিল মালিক সমিতির দাবি অনুযায়ী আমদানি প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেট যা বাজারে সাধারণ খাবার লবন নামে বাজারজাত হত তাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক বৃদ্ধি করায় বড় ধরনের সফলতা এসেছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে দেশের লবণ শিল্প আগামীতে আরও সমৃদ্ধ হবে। ইতোপূর্বে শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক অপেক্ষাকৃত কম থাকায় তা বাজারে খাবার লবণ হিসেবে দেদার বিক্রি বাজারজাত হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনও দেখা গেছে লবণ চাষীদের আহাজারি। এসব বিষয় অবহিত হয়ে সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের আগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পরিচালিত হয় মাঠ জরিপ। মাঠের প্রকৃত রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকারী নানাবিধ উদ্যোগ গৃহীত হয়। ফলে গেল মৌসুমে লবণ উৎপাদনে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। এবার প্রতি একরে ২৫ টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হয়েছে বলে লবণ মিল মালিকরা জানান। পক্ষান্তরে, বিসিক সূত্রে বলা হয়েছেÑ একর প্রতি লবণ মাঠ থেকে উৎপাদনের পরিমাণ কোন কোন স্থানে ২৯, কোন কোন স্থানে ৩০ টন হয়েছে। সারাদেশে বিসিকের হিসাব অনুযায়ী ৬৩ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে। লবণের বাজার মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে মিল মালিকদের মাধ্যমে বাড়তি মূল্য লিখিয়ে নেয়া হয়, যা অনৈতিক। এ বিষয়ে আগামীতে নজরদারির প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মতব্যক্ত করেছে।
তিন ক্যাটাগরিতে ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট : দেশে বর্তমানে তিন ক্যাটাগরিতে লবণের ফিনিশ্্ড প্রোডাক্ট হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে উন্নত মেকানাইজড মিল, ইভাপোরেট পদ্ধতির মিল ও ট্রেডিশনাল (পুরনো পদ্ধতির) মিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে উন্নত মেকানাইজড পদ্ধতির লবণ মিল রয়েছে ৬৭টি। ইভাপোরেট সিস্টেমের মিল রয়েছে ৫টি। এ ছাড়া ট্রেডিশনাল মিল রয়েছে ২ শতাধিক। মূলত চট্টগ্রাম, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে এ জাতীয় লবণ মিলের অবস্থান।
সোডিয়াম সালফেট : সোডিয়াম সালফেট মূলত আমদানি হয়ে থাকে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহারের জন্য। প্রকৃত শিল্প মালিকদের বাইরে সাধারণ আমদানিকারকদের জন্য উন্মুক্ত থাকার কারণে শুল্ক ফাঁকিতে আন্ডারভ্যালু করে অসাধু আমদানিকারকরা ইতোপূর্বে এর যথেচ্ছার আমদানি করেছে। সাধারণ খাবারের লবন বলে বাজারজাতও হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নানা রিপোর্টের পর সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে এর লাগাম টানা হয়েছে। ফলে সুফলও এসেছে। এর অবাধ আমদানি অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। তবে শিল্প মালিক ব্যতিরেকে সাধারণ আমদানিকারকদের পক্ষে এর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার অপরিহার্যতা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য : বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে লবণের যে মূল্য ধরা হয় তা অনেকাংশে বেশি। মিল গেট থেকে যে মূল্যে লবণ সরবরাহ করা হয় পাইকারি পর্যায়ে তা আরও বেড়ে যায়। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ব্যাপকভাবে থাকে খুচরা পর্যায়ে। এই ব্যাপারে সরকারের মনিটরিং বিষয়টি প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। মিল মালিকদের বাধ্য করা হয় প্যাকেটে অত্যধিক মূল্য ছেপে দিতে। যা কোনভাবে কাম্য হতে পারে না। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট, পটিয়ার ইন্দ্রপুল, কক্সবাজারের ইসলামপুর এলাকায় এ জাতীয় ঘটনা ঘটে আসছে।
আমদানি : দেশে লবণের পুরো চাহিদা মিটাতে সাধারণত পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে লবণ আমদানি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন বাড়লে আমদানি কমে যায়। আর উৎপাদন হ্রাস পেলে আমদানি বেড়ে যায়। ভারতের গুজরাট, কর্ণাটক, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণত দেশে লবন আমদানি হয়েছে ইতোপূর্বেকার বছরগুলোতে। তবে গেল বছর আমদানি হয়নি বললেই চলে। লবন চাষীরা আগেভাগে মাঠে নেমে যাওয়ায় ইতিবাচক সুফল মিলেছে। সাধারণত কুতুবদিয়া দ্বীপের চাষীরা প্রতিবছর মওসুম শুরু হওয়ার আগেই মাঠে নেমে যায়। এবারও অনুরূপ বিষয়টি অবতারণা হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ভাল মূল্য পেয়েছে। এখনও পাচ্ছে। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের শুরুতে খোদ প্রধানমন্ত্রী চাষীদের উৎপাদনমুখী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেয়ার পর দেশের লবণের মাঠগুলোতে চাষীরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নেমে যায়। এর পাশাপাশি আবহাওয়ার
বৈরী কোন পরিবেশ না হওয়ায় এবার উৎপাদন হয়েছে বাম্পার। অতীতের রেকর্ড হয়েছে অতিক্রম। যা সার্বিকভাবে এই শিল্পের জন্য ইতিবাচক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
উৎপাদন আরও বৃদ্ধির আহ্বান : লবণ উৎপাদন শিল্পে জড়িতদের পক্ষ থেকে দেশের আরও কয়েকটি স্থানে লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম স্থানগুলো হচ্ছে কুয়াকাটা, বরিশাল, খুলনা, মীরসরাই ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু লবণ শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এ অবস্থায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উপরোক্ত স্থানসমূহের লবণের মাঠ সৃষ্টির জন্য যাবতীয় সহায়তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মাধ্যমে দিতে পারে। যার মধ্যে বিসিক অন্যতম। কেননা এসব এলাকা উপকূলবর্তী এবং সাগরে লবণাক্ত পানির সুবিধা রয়েছে। যে পানি থেকে লবণ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক নিয়মে।
সাহায্য সংস্থার অনিয়ম : এদিকে লবণ শিল্পে উন্নতির ব্যানারে একটি সাহায্য সংস্থার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। লজিস্টিক সাপোর্টের নামে এ সংস্থার কয়েক কর্মকর্তা এবং কক্সবাজার অঞ্চলের ইসলামপুরের স্বঘোষিত মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও তার নিকটাত্মীয়ের যোগসাজশে সহায়তার অর্থ গত ১৮ সাল থেকে লোপাট করে চলেছে। এ পর্যন্ত লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ ১২ কোটি টাকারও বেশি। এ বিসয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। সূত্র জানিয়েছে, উক্ত সাহায্য সংস্থা শিল্প মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে, বিসিক লবণ মিল মালিক সমিতি ও চাষী কল্যাণ সমিতিকে অবহিত না করে এই শিল্পে কী ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে তা বিস্ময়কর। বিষয়টি দেশে বিদেশে এ শিল্প নিয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় বয়ে আসছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে।
মিল মালিক সমিতির বক্তব্য : বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবীর জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমান সরকারের পক্ষে লবণ উৎপাদন নিয়ে চাষীদের সঙ্গে সরাসরি সেতুবন্ধন রচনা করা হয়েছে। তাদের অভয় দেয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি না করার আভাস দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ের কারণে এবারের লবণ উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। সরকার পক্ষে নজরদারি অব্যাহত রাখা হলে খুব বেশি সময় নেবে না এদেশ লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। অতীতে লবণের প্রান্তিক চাষীরা কেঁদেছে। এবার হাসছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি ইতিবাচক প্রভাব বয়ে এনেছে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
কাজিরবাজার ডেস্ক
সদ্য সমাপ্ত উৎপাদন মৌসুমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদন মোট চাহিদার কাছাকাছি চলে আসায় দেশের ইতিহাসে লবণ খাতে রেকর্ড গড়েছে। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে অপেক্ষাকৃত অনুকূল আবহাওয়া, রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের পক্ষ থেকে তদারকি ও নানা উদ্যোগ এবং লবণ চাষীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রাখা ও শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের শুল্কহার বৃদ্ধি করার জের হিসেবে লবণ উৎপাদন নজিরবিহীন সাফল্য এসেছে। হাসি ফুটেছে প্রান্তিক চাষীদের মুখে। বাজারজাত প্রক্রিয়ায় এসেছে গতিশীলতা। হ্রাস পাবে ভবিষ্যত আমদানি। প্রান্তিক চাষী, লবণ মিল মালিক সমিতি, বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের পরিসংখ্যানে এসব তথ্য মিলেছে। বিসিক ও বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। যা অতীত ইতিহাসের রেকর্ড। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে গত ২১ মে লবন উৎপাদন মওসুম সমাপ্ত হয়েছে। সাধারণত নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে লবন চাষীরা মাঠে নেমে যান। উৎপাদন শুরু হয় জানুয়ারির প্রথমার্ধ থেকে। প্রাকৃতিক কোন বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি না হলে তা টানা চলে মে মাস পর্যন্ত। মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজেলায় লবণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে কক্সবাজারে কুতুবদিয়ার লেমশীখালী, মহেশখালী উপজেলার উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা, মাতারবাড়ী, ঈদগাঁও উপজেলার গোমাতলী, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, পেকুয়া উপজেলার দরবেশকাটা, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফের সদর এলাকা, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনা ও সরল এলাকায় লবণের চাষ হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, চলতি বছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। মৌসুম শেষে বিসিকের হিসাবে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চাহিদার বাকি রয়েছে মাত্র ৫ লাখ টন। যা অতীতে কখনও হয়নি। গেল মৌসুমে মোট লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৮শ’ ২০ টন। এবার প্রায় ২ লাখ টন বেশি উৎপাদিত হয়েছে।
এ সাফল্যের নেপথ্যের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে মাঠ পর্যায়ের চাষী, মিল মালিক সমিতি এবং বিসিকের পক্ষ থেকে যুগপৎভাবে জানানো হয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতে চাষীদের মাঠে নামার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি উৎপাদিত লবণ নিয়ে প্রান্তিক চাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তা নিয়ে কথা দিয়েছেন। ফলে চাষীদের মধ্যে সাড়া পড়ে ব্যাপক। এ ছাড়া লবণ মিল মালিক সমিতির দাবি অনুযায়ী আমদানি প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেট যা বাজারে সাধারণ খাবার লবন নামে বাজারজাত হত তাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক বৃদ্ধি করায় বড় ধরনের সফলতা এসেছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে দেশের লবণ শিল্প আগামীতে আরও সমৃদ্ধ হবে। ইতোপূর্বে শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক অপেক্ষাকৃত কম থাকায় তা বাজারে খাবার লবণ হিসেবে দেদার বিক্রি বাজারজাত হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনও দেখা গেছে লবণ চাষীদের আহাজারি। এসব বিষয় অবহিত হয়ে সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের আগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পরিচালিত হয় মাঠ জরিপ। মাঠের প্রকৃত রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকারী নানাবিধ উদ্যোগ গৃহীত হয়। ফলে গেল মৌসুমে লবণ উৎপাদনে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। এবার প্রতি একরে ২৫ টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হয়েছে বলে লবণ মিল মালিকরা জানান। পক্ষান্তরে, বিসিক সূত্রে বলা হয়েছেÑ একর প্রতি লবণ মাঠ থেকে উৎপাদনের পরিমাণ কোন কোন স্থানে ২৯, কোন কোন স্থানে ৩০ টন হয়েছে। সারাদেশে বিসিকের হিসাব অনুযায়ী ৬৩ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে। লবণের বাজার মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে মিল মালিকদের মাধ্যমে বাড়তি মূল্য লিখিয়ে নেয়া হয়, যা অনৈতিক। এ বিষয়ে আগামীতে নজরদারির প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মতব্যক্ত করেছে।
তিন ক্যাটাগরিতে ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট : দেশে বর্তমানে তিন ক্যাটাগরিতে লবণের ফিনিশ্্ড প্রোডাক্ট হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে উন্নত মেকানাইজড মিল, ইভাপোরেট পদ্ধতির মিল ও ট্রেডিশনাল (পুরনো পদ্ধতির) মিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে উন্নত মেকানাইজড পদ্ধতির লবণ মিল রয়েছে ৬৭টি। ইভাপোরেট সিস্টেমের মিল রয়েছে ৫টি। এ ছাড়া ট্রেডিশনাল মিল রয়েছে ২ শতাধিক। মূলত চট্টগ্রাম, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে এ জাতীয় লবণ মিলের অবস্থান।
সোডিয়াম সালফেট : সোডিয়াম সালফেট মূলত আমদানি হয়ে থাকে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহারের জন্য। প্রকৃত শিল্প মালিকদের বাইরে সাধারণ আমদানিকারকদের জন্য উন্মুক্ত থাকার কারণে শুল্ক ফাঁকিতে আন্ডারভ্যালু করে অসাধু আমদানিকারকরা ইতোপূর্বে এর যথেচ্ছার আমদানি করেছে। সাধারণ খাবারের লবন বলে বাজারজাতও হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নানা রিপোর্টের পর সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে এর লাগাম টানা হয়েছে। ফলে সুফলও এসেছে। এর অবাধ আমদানি অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। তবে শিল্প মালিক ব্যতিরেকে সাধারণ আমদানিকারকদের পক্ষে এর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার অপরিহার্যতা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য : বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে লবণের যে মূল্য ধরা হয় তা অনেকাংশে বেশি। মিল গেট থেকে যে মূল্যে লবণ সরবরাহ করা হয় পাইকারি পর্যায়ে তা আরও বেড়ে যায়। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ব্যাপকভাবে থাকে খুচরা পর্যায়ে। এই ব্যাপারে সরকারের মনিটরিং বিষয়টি প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। মিল মালিকদের বাধ্য করা হয় প্যাকেটে অত্যধিক মূল্য ছেপে দিতে। যা কোনভাবে কাম্য হতে পারে না। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট, পটিয়ার ইন্দ্রপুল, কক্সবাজারের ইসলামপুর এলাকায় এ জাতীয় ঘটনা ঘটে আসছে।
আমদানি : দেশে লবণের পুরো চাহিদা মিটাতে সাধারণত পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে লবণ আমদানি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন বাড়লে আমদানি কমে যায়। আর উৎপাদন হ্রাস পেলে আমদানি বেড়ে যায়। ভারতের গুজরাট, কর্ণাটক, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণত দেশে লবন আমদানি হয়েছে ইতোপূর্বেকার বছরগুলোতে। তবে গেল বছর আমদানি হয়নি বললেই চলে। লবন চাষীরা আগেভাগে মাঠে নেমে যাওয়ায় ইতিবাচক সুফল মিলেছে। সাধারণত কুতুবদিয়া দ্বীপের চাষীরা প্রতিবছর মওসুম শুরু হওয়ার আগেই মাঠে নেমে যায়। এবারও অনুরূপ বিষয়টি অবতারণা হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ভাল মূল্য পেয়েছে। এখনও পাচ্ছে। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের শুরুতে খোদ প্রধানমন্ত্রী চাষীদের উৎপাদনমুখী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেয়ার পর দেশের লবণের মাঠগুলোতে চাষীরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নেমে যায়। এর পাশাপাশি আবহাওয়ার
বৈরী কোন পরিবেশ না হওয়ায় এবার উৎপাদন হয়েছে বাম্পার। অতীতের রেকর্ড হয়েছে অতিক্রম। যা সার্বিকভাবে এই শিল্পের জন্য ইতিবাচক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
উৎপাদন আরও বৃদ্ধির আহ্বান : লবণ উৎপাদন শিল্পে জড়িতদের পক্ষ থেকে দেশের আরও কয়েকটি স্থানে লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম স্থানগুলো হচ্ছে কুয়াকাটা, বরিশাল, খুলনা, মীরসরাই ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু লবণ শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এ অবস্থায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উপরোক্ত স্থানসমূহের লবণের মাঠ সৃষ্টির জন্য যাবতীয় সহায়তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মাধ্যমে দিতে পারে। যার মধ্যে বিসিক অন্যতম। কেননা এসব এলাকা উপকূলবর্তী এবং সাগরে লবণাক্ত পানির সুবিধা রয়েছে। যে পানি থেকে লবণ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক নিয়মে।
সাহায্য সংস্থার অনিয়ম : এদিকে লবণ শিল্পে উন্নতির ব্যানারে একটি সাহায্য সংস্থার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। লজিস্টিক সাপোর্টের নামে এ সংস্থার কয়েক কর্মকর্তা এবং কক্সবাজার অঞ্চলের ইসলামপুরের স্বঘোষিত মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও তার নিকটাত্মীয়ের যোগসাজশে সহায়তার অর্থ গত ১৮ সাল থেকে লোপাট করে চলেছে। এ পর্যন্ত লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ ১২ কোটি টাকারও বেশি। এ বিসয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। সূত্র জানিয়েছে, উক্ত সাহায্য সংস্থা শিল্প মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে, বিসিক লবণ মিল মালিক সমিতি ও চাষী কল্যাণ সমিতিকে অবহিত না করে এই শিল্পে কী ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে তা বিস্ময়কর। বিষয়টি দেশে বিদেশে এ শিল্প নিয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় বয়ে আসছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে।
মিল মালিক সমিতির বক্তব্য : বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবীর জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমান সরকারের পক্ষে লবণ উৎপাদন নিয়ে চাষীদের সঙ্গে সরাসরি সেতুবন্ধন রচনা করা হয়েছে। তাদের অভয় দেয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি না করার আভাস দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ের কারণে এবারের লবণ উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। সরকার পক্ষে নজরদারি অব্যাহত রাখা হলে খুব বেশি সময় নেবে না এদেশ লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। অতীতে লবণের প্রান্তিক চাষীরা কেঁদেছে। এবার হাসছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি ইতিবাচক প্রভাব বয়ে এনেছে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
কাজিরবাজার ডেস্ক
সদ্য সমাপ্ত উৎপাদন মৌসুমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদন মোট চাহিদার কাছাকাছি চলে আসায় দেশের ইতিহাসে লবণ খাতে রেকর্ড গড়েছে। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে অপেক্ষাকৃত অনুকূল আবহাওয়া, রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের পক্ষ থেকে তদারকি ও নানা উদ্যোগ এবং লবণ চাষীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রাখা ও শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের শুল্কহার বৃদ্ধি করার জের হিসেবে লবণ উৎপাদন নজিরবিহীন সাফল্য এসেছে। হাসি ফুটেছে প্রান্তিক চাষীদের মুখে। বাজারজাত প্রক্রিয়ায় এসেছে গতিশীলতা। হ্রাস পাবে ভবিষ্যত আমদানি। প্রান্তিক চাষী, লবণ মিল মালিক সমিতি, বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের পরিসংখ্যানে এসব তথ্য মিলেছে। বিসিক ও বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। যা অতীত ইতিহাসের রেকর্ড। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে গত ২১ মে লবন উৎপাদন মওসুম সমাপ্ত হয়েছে। সাধারণত নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে লবন চাষীরা মাঠে নেমে যান। উৎপাদন শুরু হয় জানুয়ারির প্রথমার্ধ থেকে। প্রাকৃতিক কোন বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি না হলে তা টানা চলে মে মাস পর্যন্ত। মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজেলায় লবণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে কক্সবাজারে কুতুবদিয়ার লেমশীখালী, মহেশখালী উপজেলার উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা, মাতারবাড়ী, ঈদগাঁও উপজেলার গোমাতলী, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, পেকুয়া উপজেলার দরবেশকাটা, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফের সদর এলাকা, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনা ও সরল এলাকায় লবণের চাষ হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, চলতি বছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। মৌসুম শেষে বিসিকের হিসাবে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চাহিদার বাকি রয়েছে মাত্র ৫ লাখ টন। যা অতীতে কখনও হয়নি। গেল মৌসুমে মোট লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৮শ’ ২০ টন। এবার প্রায় ২ লাখ টন বেশি উৎপাদিত হয়েছে।
এ সাফল্যের নেপথ্যের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে মাঠ পর্যায়ের চাষী, মিল মালিক সমিতি এবং বিসিকের পক্ষ থেকে যুগপৎভাবে জানানো হয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতে চাষীদের মাঠে নামার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি উৎপাদিত লবণ নিয়ে প্রান্তিক চাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তা নিয়ে কথা দিয়েছেন। ফলে চাষীদের মধ্যে সাড়া পড়ে ব্যাপক। এ ছাড়া লবণ মিল মালিক সমিতির দাবি অনুযায়ী আমদানি প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেট যা বাজারে সাধারণ খাবার লবন নামে বাজারজাত হত তাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক বৃদ্ধি করায় বড় ধরনের সফলতা এসেছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে দেশের লবণ শিল্প আগামীতে আরও সমৃদ্ধ হবে। ইতোপূর্বে শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক অপেক্ষাকৃত কম থাকায় তা বাজারে খাবার লবণ হিসেবে দেদার বিক্রি বাজারজাত হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনও দেখা গেছে লবণ চাষীদের আহাজারি। এসব বিষয় অবহিত হয়ে সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের আগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পরিচালিত হয় মাঠ জরিপ। মাঠের প্রকৃত রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকারী নানাবিধ উদ্যোগ গৃহীত হয়। ফলে গেল মৌসুমে লবণ উৎপাদনে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। এবার প্রতি একরে ২৫ টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হয়েছে বলে লবণ মিল মালিকরা জানান। পক্ষান্তরে, বিসিক সূত্রে বলা হয়েছেÑ একর প্রতি লবণ মাঠ থেকে উৎপাদনের পরিমাণ কোন কোন স্থানে ২৯, কোন কোন স্থানে ৩০ টন হয়েছে। সারাদেশে বিসিকের হিসাব অনুযায়ী ৬৩ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে। লবণের বাজার মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে মিল মালিকদের মাধ্যমে বাড়তি মূল্য লিখিয়ে নেয়া হয়, যা অনৈতিক। এ বিষয়ে আগামীতে নজরদারির প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মতব্যক্ত করেছে।
তিন ক্যাটাগরিতে ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট : দেশে বর্তমানে তিন ক্যাটাগরিতে লবণের ফিনিশ্্ড প্রোডাক্ট হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে উন্নত মেকানাইজড মিল, ইভাপোরেট পদ্ধতির মিল ও ট্রেডিশনাল (পুরনো পদ্ধতির) মিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে উন্নত মেকানাইজড পদ্ধতির লবণ মিল রয়েছে ৬৭টি। ইভাপোরেট সিস্টেমের মিল রয়েছে ৫টি। এ ছাড়া ট্রেডিশনাল মিল রয়েছে ২ শতাধিক। মূলত চট্টগ্রাম, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে এ জাতীয় লবণ মিলের অবস্থান।
সোডিয়াম সালফেট : সোডিয়াম সালফেট মূলত আমদানি হয়ে থাকে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহারের জন্য। প্রকৃত শিল্প মালিকদের বাইরে সাধারণ আমদানিকারকদের জন্য উন্মুক্ত থাকার কারণে শুল্ক ফাঁকিতে আন্ডারভ্যালু করে অসাধু আমদানিকারকরা ইতোপূর্বে এর যথেচ্ছার আমদানি করেছে। সাধারণ খাবারের লবন বলে বাজারজাতও হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নানা রিপোর্টের পর সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে এর লাগাম টানা হয়েছে। ফলে সুফলও এসেছে। এর অবাধ আমদানি অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। তবে শিল্প মালিক ব্যতিরেকে সাধারণ আমদানিকারকদের পক্ষে এর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার অপরিহার্যতা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য : বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে লবণের যে মূল্য ধরা হয় তা অনেকাংশে বেশি। মিল গেট থেকে যে মূল্যে লবণ সরবরাহ করা হয় পাইকারি পর্যায়ে তা আরও বেড়ে যায়। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ব্যাপকভাবে থাকে খুচরা পর্যায়ে। এই ব্যাপারে সরকারের মনিটরিং বিষয়টি প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। মিল মালিকদের বাধ্য করা হয় প্যাকেটে অত্যধিক মূল্য ছেপে দিতে। যা কোনভাবে কাম্য হতে পারে না। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট, পটিয়ার ইন্দ্রপুল, কক্সবাজারের ইসলামপুর এলাকায় এ জাতীয় ঘটনা ঘটে আসছে।
আমদানি : দেশে লবণের পুরো চাহিদা মিটাতে সাধারণত পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে লবণ আমদানি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন বাড়লে আমদানি কমে যায়। আর উৎপাদন হ্রাস পেলে আমদানি বেড়ে যায়। ভারতের গুজরাট, কর্ণাটক, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণত দেশে লবন আমদানি হয়েছে ইতোপূর্বেকার বছরগুলোতে। তবে গেল বছর আমদানি হয়নি বললেই চলে। লবন চাষীরা আগেভাগে মাঠে নেমে যাওয়ায় ইতিবাচক সুফল মিলেছে। সাধারণত কুতুবদিয়া দ্বীপের চাষীরা প্রতিবছর মওসুম শুরু হওয়ার আগেই মাঠে নেমে যায়। এবারও অনুরূপ বিষয়টি অবতারণা হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ভাল মূল্য পেয়েছে। এখনও পাচ্ছে। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের শুরুতে খোদ প্রধানমন্ত্রী চাষীদের উৎপাদনমুখী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেয়ার পর দেশের লবণের মাঠগুলোতে চাষীরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নেমে যায়। এর পাশাপাশি আবহাওয়ার
বৈরী কোন পরিবেশ না হওয়ায় এবার উৎপাদন হয়েছে বাম্পার। অতীতের রেকর্ড হয়েছে অতিক্রম। যা সার্বিকভাবে এই শিল্পের জন্য ইতিবাচক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
উৎপাদন আরও বৃদ্ধির আহ্বান : লবণ উৎপাদন শিল্পে জড়িতদের পক্ষ থেকে দেশের আরও কয়েকটি স্থানে লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম স্থানগুলো হচ্ছে কুয়াকাটা, বরিশাল, খুলনা, মীরসরাই ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু লবণ শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এ অবস্থায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উপরোক্ত স্থানসমূহের লবণের মাঠ সৃষ্টির জন্য যাবতীয় সহায়তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মাধ্যমে দিতে পারে। যার মধ্যে বিসিক অন্যতম। কেননা এসব এলাকা উপকূলবর্তী এবং সাগরে লবণাক্ত পানির সুবিধা রয়েছে। যে পানি থেকে লবণ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক নিয়মে।
সাহায্য সংস্থার অনিয়ম : এদিকে লবণ শিল্পে উন্নতির ব্যানারে একটি সাহায্য সংস্থার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। লজিস্টিক সাপোর্টের নামে এ সংস্থার কয়েক কর্মকর্তা এবং কক্সবাজার অঞ্চলের ইসলামপুরের স্বঘোষিত মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও তার নিকটাত্মীয়ের যোগসাজশে সহায়তার অর্থ গত ১৮ সাল থেকে লোপাট করে চলেছে। এ পর্যন্ত লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ ১২ কোটি টাকারও বেশি। এ বিসয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। সূত্র জানিয়েছে, উক্ত সাহায্য সংস্থা শিল্প মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে, বিসিক লবণ মিল মালিক সমিতি ও চাষী কল্যাণ সমিতিকে অবহিত না করে এই শিল্পে কী ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে তা বিস্ময়কর। বিষয়টি দেশে বিদেশে এ শিল্প নিয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় বয়ে আসছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে।
মিল মালিক সমিতির বক্তব্য : বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবীর জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমান সরকারের পক্ষে লবণ উৎপাদন নিয়ে চাষীদের সঙ্গে সরাসরি সেতুবন্ধন রচনা করা হয়েছে। তাদের অভয় দেয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি না করার আভাস দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ের কারণে এবারের লবণ উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। সরকার পক্ষে নজরদারি অব্যাহত রাখা হলে খুব বেশি সময় নেবে না এদেশ লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। অতীতে লবণের প্রান্তিক চাষীরা কেঁদেছে। এবার হাসছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি ইতিবাচক প্রভাব বয়ে এনেছে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
কাজিরবাজার ডেস্ক
সদ্য সমাপ্ত উৎপাদন মৌসুমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদন মোট চাহিদার কাছাকাছি চলে আসায় দেশের ইতিহাসে লবণ খাতে রেকর্ড গড়েছে। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে অপেক্ষাকৃত অনুকূল আবহাওয়া, রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের পক্ষ থেকে তদারকি ও নানা উদ্যোগ এবং লবণ চাষীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ রাখা ও শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের শুল্কহার বৃদ্ধি করার জের হিসেবে লবণ উৎপাদন নজিরবিহীন সাফল্য এসেছে। হাসি ফুটেছে প্রান্তিক চাষীদের মুখে। বাজারজাত প্রক্রিয়ায় এসেছে গতিশীলতা। হ্রাস পাবে ভবিষ্যত আমদানি। প্রান্তিক চাষী, লবণ মিল মালিক সমিতি, বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের পরিসংখ্যানে এসব তথ্য মিলেছে। বিসিক ও বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। যা অতীত ইতিহাসের রেকর্ড। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে গত ২১ মে লবন উৎপাদন মওসুম সমাপ্ত হয়েছে। সাধারণত নবেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে লবন চাষীরা মাঠে নেমে যান। উৎপাদন শুরু হয় জানুয়ারির প্রথমার্ধ থেকে। প্রাকৃতিক কোন বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি না হলে তা টানা চলে মে মাস পর্যন্ত। মূলত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজেলায় লবণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে কক্সবাজারে কুতুবদিয়ার লেমশীখালী, মহেশখালী উপজেলার উত্তর নলবিলা, গোরকঘাটা, মাতারবাড়ী, ঈদগাঁও উপজেলার গোমাতলী, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী, পেকুয়া উপজেলার দরবেশকাটা, চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফের সদর এলাকা, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর পূর্ব বড়ঘোনা ও সরল এলাকায় লবণের চাষ হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, চলতি বছর (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) লবণের চাহিদা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। মৌসুম শেষে বিসিকের হিসাবে উৎপাদিত হয়েছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চাহিদার বাকি রয়েছে মাত্র ৫ লাখ টন। যা অতীতে কখনও হয়নি। গেল মৌসুমে মোট লবণ উৎপাদন হয়েছিল ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৮শ’ ২০ টন। এবার প্রায় ২ লাখ টন বেশি উৎপাদিত হয়েছে।
এ সাফল্যের নেপথ্যের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে মাঠ পর্যায়ের চাষী, মিল মালিক সমিতি এবং বিসিকের পক্ষ থেকে যুগপৎভাবে জানানো হয়েছে, খোদ প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতে চাষীদের মাঠে নামার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি উৎপাদিত লবণ নিয়ে প্রান্তিক চাষীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায় তা নিয়ে কথা দিয়েছেন। ফলে চাষীদের মধ্যে সাড়া পড়ে ব্যাপক। এ ছাড়া লবণ মিল মালিক সমিতির দাবি অনুযায়ী আমদানি প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেট যা বাজারে সাধারণ খাবার লবন নামে বাজারজাত হত তাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক বৃদ্ধি করায় বড় ধরনের সফলতা এসেছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে করে দেশের লবণ শিল্প আগামীতে আরও সমৃদ্ধ হবে। ইতোপূর্বে শিল্পে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক অপেক্ষাকৃত কম থাকায় তা বাজারে খাবার লবণ হিসেবে দেদার বিক্রি বাজারজাত হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনও দেখা গেছে লবণ চাষীদের আহাজারি। এসব বিষয় অবহিত হয়ে সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের আগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পরিচালিত হয় মাঠ জরিপ। মাঠের প্রকৃত রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকারী নানাবিধ উদ্যোগ গৃহীত হয়। ফলে গেল মৌসুমে লবণ উৎপাদনে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। এবার প্রতি একরে ২৫ টনেরও বেশি লবণ উৎপাদিত হয়েছে বলে লবণ মিল মালিকরা জানান। পক্ষান্তরে, বিসিক সূত্রে বলা হয়েছেÑ একর প্রতি লবণ মাঠ থেকে উৎপাদনের পরিমাণ কোন কোন স্থানে ২৯, কোন কোন স্থানে ৩০ টন হয়েছে। সারাদেশে বিসিকের হিসাব অনুযায়ী ৬৩ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছে। লবণের বাজার মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে মিল মালিকদের মাধ্যমে বাড়তি মূল্য লিখিয়ে নেয়া হয়, যা অনৈতিক। এ বিষয়ে আগামীতে নজরদারির প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মতব্যক্ত করেছে।
তিন ক্যাটাগরিতে ফিনিশ্ড প্রোডাক্ট : দেশে বর্তমানে তিন ক্যাটাগরিতে লবণের ফিনিশ্্ড প্রোডাক্ট হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে উন্নত মেকানাইজড মিল, ইভাপোরেট পদ্ধতির মিল ও ট্রেডিশনাল (পুরনো পদ্ধতির) মিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে উন্নত মেকানাইজড পদ্ধতির লবণ মিল রয়েছে ৬৭টি। ইভাপোরেট সিস্টেমের মিল রয়েছে ৫টি। এ ছাড়া ট্রেডিশনাল মিল রয়েছে ২ শতাধিক। মূলত চট্টগ্রাম, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে এ জাতীয় লবণ মিলের অবস্থান।
সোডিয়াম সালফেট : সোডিয়াম সালফেট মূলত আমদানি হয়ে থাকে বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহারের জন্য। প্রকৃত শিল্প মালিকদের বাইরে সাধারণ আমদানিকারকদের জন্য উন্মুক্ত থাকার কারণে শুল্ক ফাঁকিতে আন্ডারভ্যালু করে অসাধু আমদানিকারকরা ইতোপূর্বে এর যথেচ্ছার আমদানি করেছে। সাধারণ খাবারের লবন বলে বাজারজাতও হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নানা রিপোর্টের পর সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়ে এর লাগাম টানা হয়েছে। ফলে সুফলও এসেছে। এর অবাধ আমদানি অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। তবে শিল্প মালিক ব্যতিরেকে সাধারণ আমদানিকারকদের পক্ষে এর আমদানি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার অপরিহার্যতা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য : বর্তমানে ভোক্তা পর্যায়ে লবণের যে মূল্য ধরা হয় তা অনেকাংশে বেশি। মিল গেট থেকে যে মূল্যে লবণ সরবরাহ করা হয় পাইকারি পর্যায়ে তা আরও বেড়ে যায়। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ব্যাপকভাবে থাকে খুচরা পর্যায়ে। এই ব্যাপারে সরকারের মনিটরিং বিষয়টি প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে মত ব্যক্ত করা হয়েছে। মিল মালিকদের বাধ্য করা হয় প্যাকেটে অত্যধিক মূল্য ছেপে দিতে। যা কোনভাবে কাম্য হতে পারে না। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট, পটিয়ার ইন্দ্রপুল, কক্সবাজারের ইসলামপুর এলাকায় এ জাতীয় ঘটনা ঘটে আসছে।
আমদানি : দেশে লবণের পুরো চাহিদা মিটাতে সাধারণত পাশর্^বর্তী দেশ ভারত থেকে লবণ আমদানি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দেশে উৎপাদন বাড়লে আমদানি কমে যায়। আর উৎপাদন হ্রাস পেলে আমদানি বেড়ে যায়। ভারতের গুজরাট, কর্ণাটক, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণত দেশে লবন আমদানি হয়েছে ইতোপূর্বেকার বছরগুলোতে। তবে গেল বছর আমদানি হয়নি বললেই চলে। লবন চাষীরা আগেভাগে মাঠে নেমে যাওয়ায় ইতিবাচক সুফল মিলেছে। সাধারণত কুতুবদিয়া দ্বীপের চাষীরা প্রতিবছর মওসুম শুরু হওয়ার আগেই মাঠে নেমে যায়। এবারও অনুরূপ বিষয়টি অবতারণা হয়েছে। ফলে লবণ চাষীরা ভাল মূল্য পেয়েছে। এখনও পাচ্ছে। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত মৌসুমের শুরুতে খোদ প্রধানমন্ত্রী চাষীদের উৎপাদনমুখী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেয়ার পর দেশের লবণের মাঠগুলোতে চাষীরা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নেমে যায়। এর পাশাপাশি আবহাওয়ার
বৈরী কোন পরিবেশ না হওয়ায় এবার উৎপাদন হয়েছে বাম্পার। অতীতের রেকর্ড হয়েছে অতিক্রম। যা সার্বিকভাবে এই শিল্পের জন্য ইতিবাচক বলে বিবেচিত হচ্ছে।
উৎপাদন আরও বৃদ্ধির আহ্বান : লবণ উৎপাদন শিল্পে জড়িতদের পক্ষ থেকে দেশের আরও কয়েকটি স্থানে লবণ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম স্থানগুলো হচ্ছে কুয়াকাটা, বরিশাল, খুলনা, মীরসরাই ও সেন্টমার্টিন দ্বীপ। সূত্র জানিয়েছে, যেহেতু লবণ শিল্প মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এ অবস্থায় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল উপরোক্ত স্থানসমূহের লবণের মাঠ সৃষ্টির জন্য যাবতীয় সহায়তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের মাধ্যমে দিতে পারে। যার মধ্যে বিসিক অন্যতম। কেননা এসব এলাকা উপকূলবর্তী এবং সাগরে লবণাক্ত পানির সুবিধা রয়েছে। যে পানি থেকে লবণ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিক নিয়মে।
সাহায্য সংস্থার অনিয়ম : এদিকে লবণ শিল্পে উন্নতির ব্যানারে একটি সাহায্য সংস্থার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। লজিস্টিক সাপোর্টের নামে এ সংস্থার কয়েক কর্মকর্তা এবং কক্সবাজার অঞ্চলের ইসলামপুরের স্বঘোষিত মিল মালিক সমিতির সভাপতি ও তার নিকটাত্মীয়ের যোগসাজশে সহায়তার অর্থ গত ১৮ সাল থেকে লোপাট করে চলেছে। এ পর্যন্ত লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ ১২ কোটি টাকারও বেশি। এ বিসয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে। সূত্র জানিয়েছে, উক্ত সাহায্য সংস্থা শিল্প মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে, বিসিক লবণ মিল মালিক সমিতি ও চাষী কল্যাণ সমিতিকে অবহিত না করে এই শিল্পে কী ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকে তা বিস্ময়কর। বিষয়টি দেশে বিদেশে এ শিল্প নিয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় বয়ে আসছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে।
মিল মালিক সমিতির বক্তব্য : বাংলাদেশ সল্ট মিল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবীর জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমান সরকারের পক্ষে লবণ উৎপাদন নিয়ে চাষীদের সঙ্গে সরাসরি সেতুবন্ধন রচনা করা হয়েছে। তাদের অভয় দেয়া হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি না করার আভাস দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সোডিয়াম সালফেটের আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ের কারণে এবারের লবণ উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। সরকার পক্ষে নজরদারি অব্যাহত রাখা হলে খুব বেশি সময় নেবে না এদেশ লবণে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। অতীতে লবণের প্রান্তিক চাষীরা কেঁদেছে। এবার হাসছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি ইতিবাচক প্রভাব বয়ে এনেছে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।