‘ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা বিশ^াসের সুযোগ নিয়েছেন’ ॥ লাইসেন্স, ডিলারশিপ বাতিলের নির্দেশনা

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভোজ্যতেলের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারের ‘বিশ্বাসের সুযোগ’ নিয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, বেশি মুনাফার আশায় তেল ধরে রেখে তারা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করেছেন। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি হয়েছে। শুধু তাই নয় যারা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছেন ইতোমধ্যে তারা চিহ্নিত হয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীর ডিলারশিপ এবং লাইসেন্স বাতিল করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সোমবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ভোজ্যতেল নিয়ে বৈঠক শেষে প্রেসব্রিফিংয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এসব কথা বলেন। এদিকে সারাদেশে ব্যবসায়ীদের মজুদকৃত তেল উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বাজারে সোমবার একটি দোকানে ‘গোপনে মজুদ করে রাখা’ ১৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেলের সন্ধান পেয়েছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। আর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তিনটি দোকানকে তারা জরিমানা করেছেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করার অভিযোগে। চলমান অভিযানে দেশের অন্যান্য স্থানে হাজার হাজার লিটার তেল উদ্ধার হচ্ছে। মজুদকৃত তেল উদ্ধারে আরও কঠোর অভিযান পরিচালনা করার কথা জানিয়েছে ভোক্তা অধিদফতর।
এছাড়া দেশের বড় বড় বাজারের মুদিপণ্যের দোকানগুলোতে নতুন দামের তেল সরবরাহ শুরু হয়েছে। আর পুরো বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। ঢাকার অধিকাংশ বাজারে এখনও সয়াবিন ও পামঅয়েল তেল পাওয়া যাচ্ছে না। পুরনো তেল যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাও বিক্রি হচ্ছে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে। খোলা পামঅয়েল ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার। এছাড়া পাঁচ লিটারের ক্যান বিক্রি হচ্ছে হাজার টাকার ওপরে। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, ডিলার কিংবা পরিবেশকরা তেল দিচ্ছে না। আবার বড় বড় বাজারে কিছু তেল পাওয়া গেলেও তা চাল, চিনি, চা কিংবা অন্যান্য মুদিপণ্যের কেনার শর্ত হিসেবে দেয়া হচ্ছে। ফলে ভোজ্যতেলের বাজারের অস্থিরতা কমছে না। চলতি মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় রান্নায় ব্যবহৃত সয়াবিন তেল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সায় নিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করেন মিল মালিকরা। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বাড়তি লাভের জন্য ব্যবসায়ীরা ১০ দিনে ৪০ হাজার টনের মতো সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুদ করেছেন বলে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের ধারণা। এতে তারা অতিরিক্ত দেড়শ’ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করার সুযোগ নিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম এটাই আমাদের ব্যর্থতা। বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মিল মালিকরা কথা রাখলেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন।’ সয়াবিন তেল নিয়ে ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা কারসাজি করেছেন। তেল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের যেসব ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। যখন যেখানে প্রয়োজন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু তারা সংখ্যায় লাখের ওপরে। এটা একটা সমস্যা। ভোক্তাদের উদ্দেশে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সত্য যতই কঠিন হোক, তা মেনে নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিন। পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের এখনকার দামও বিবেচনায় নিতে হবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে তেলের দাম নির্ধারণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে রোজার মধ্যেই আরেকবার দাম পরিবর্তন করা প্রয়োজন ছিল বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তবে রোজায় যাতে মানুষের কষ্ট না হয়, সেজন্য তিনি মিল মালিকদের অনুরোধ করে দাম বৃদ্ধি কিছুটা বিলম্বিত করেছিলেন। মন্ত্রী বলেন, এখন তো দেখছি রোজার ভিতর একবার দাম বৃদ্ধি করাই ভালো ছিল। মিল মালিকরা মেনে নিলেও খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ঠিকই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঈদের পরে তেলের দাম বাড়বে, এটা সবাই অনুমান করতে পারছিলেন। শুধু তাই নয়, তেলের উচ্চমূল্যে দরিদ্র মানুষ যাতে চাপে না পড়ে, সেজন্য সরকার টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ১ কোটি দরিদ্র পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করবে। আগামী জুন মাসে টিসিবি এসব পণ্য সরবরাহ করবে।
অসাধু ব্যবসায়ীরা চিহ্নিত : ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজির সঙ্গে জড়িত অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, দেশে ভোজ্যতেল নিয়ে যারা সঙ্কট তৈরি করেছেন তারা চিহ্নিত হয়েছে। এই ব্যবসায়ীদের তথ্য প্রকাশ করা হবে। আগামীতে তেলের দাম বাড়বে কিনা এমন প্রশ্নে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক বাজার মনিটর করব। আশপাশের দেশগুলো দেখে বিবেচনা করব সবকিছু। যতদূর দাম কমানো যায় তার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, এলসি কত দামে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ক্লিয়ার করল সেটা ধরে তেলের দাম নির্ধারণ হয়। আজকে ২৫০ টাকা হয়েছে সেটা ধরে কিন্তু দাম নির্ধারণ হচ্ছে না। আজকের দামে যদি ফিক্স করতাম তাহলে গতকাল টনপ্রতি তেলের দাম ছিল ১৯৫০ ডলার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের প্রশংসা করে মন্ত্রী বলেন, ভোক্তা অধিকার আমাদের সাহায্য করছে। এত হাজার হাজার ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছানো মুশকিল। যেখানে যেখানে সম্ভব আমরা চেষ্টা করছি।
তেলের সঙ্কট তৈরি করা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, খুচরা পর্যায়ে কিন্তু কাজটি করেছে। আমাদের ভোক্তা অধিকার যেখানেই এ ধরনের ঘটনা পাচ্ছে তাদের জরিমানা-মামলা করছে। এছাড়া আমরা এ্যাসোসিয়েশনকে বলেছি তাদেরও ব্যবস্থা নিতে হবে। মিল মালিকদেরও করতে হবে মনিটরিং। কোন কোন জায়গায় এ ধরনের ডিলার আছে তাদের ডিলারশিপ বাতিল করতে পারেন। আইনগতভাবে যেখানে যেটা দরকার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভোজ্যতেল নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের কথা রাখেনি উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, বলেছিলাম রমজানকে সামনে রেখে দাম বাড়াবেন না। কিন্তু তারা ঈদের সাতদিন সেই কথা রাখেনি। আমাদের সব অর্গানাইজেশনকে বলেছি, যে দাম নির্ধারিত আছে সেটি যাতে ঠিক রাখা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কত বেড়েছে তা মিডিয়ায় আসা উচিত বলে জানান টিপু মুনশি। তিনি বলেন, লন্ডনে এক লিটার তেল ফিক্সআপ করে দেয়া হয়েছে, জার্মানিতে তেলই পাওয়া যাচ্ছে না সে কথাটা জানা দরকার। যদি দাম আরও বাড়ে, যুদ্ধ অনেকদিন চলে। আবার দাম কমলে সেটাও বলা উচিত।
ভারত পাকিস্তান নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় তেলের দাম বেশি : বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও আন্তর্জাতিকভাবে তেল বৃদ্ধির খবর খুব একটা প্রচার হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কয়েকদিন ধরেই তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাগে আন্তর্জাতিকভাবেই যে তেলের দাম বেড়েছে, প্রতিবেশী ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে তেলের দামের একটি তুলনামূলক চিত্র কেউ দেখাচ্ছেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসে তেলের দাম কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা কেউ বলছেন না। মন্ত্রী আরও বলেন, এমনকি আজকে বাজারে যে তেলটা বিক্রি করছে, সেই তেলটা দুই মাস আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করানো হয়েছে। সেই তেলটা কী দামে আমদানি হয়েছে, সেটাও কেউ জানাচ্ছেন না। এগুলো যদিও জানানো দরকার। দাম বেড়েছে এটা সত্য, সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে এটাও সত্য। কিন্তু এর পেছনে আরেকটা সত্যও আছে। সেই সত্যটা যদি জানানো যেত, তাহলে মানুষ বুঝতে পারতেন সমস্যাটা কোথায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিজে তেল উৎপাদন করে না। চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ তেল দেশে উৎপাদিত হয়। সেটাও বাদাম তেল, সরিষা তেলসহ সব মিলিয়ে। বাকি ৯০ শতাংশই নির্ভর করতে হয় আমদানির উপরে। অবৈধভাবে তেল মজুদ করে বাজারে যারা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে।
তেল মজুদদারদের ঘরে : রবিবার সারাদেশে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন দোকান-গুদাম থেকে মজুদ করা সয়াবিন তেল উদ্ধারের পর সার্বিক চিত্র সম্পর্কে এমন একটি ধারণা দেন জাতীয় ভোক্তা অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সোমবারও সারাদেশে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তারা বলছেন, একদিকে মিল থেকে তেলের সরবরাহ ও অন্যদিকে ভোক্তারা তেলের নাগাল না পাওয়া সাপ্লাই চেইনের অন্তত ১০ দিনের তেল মজুদ হয়েছে। দৈনিক ৫ হাজার টন চাহিদা বিবেচনায় প্রায় ৪০ হাজার টন তেল মজুদ করা হতে পরে। এ প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, যেই তেল লিটার ১৬০ টাকা বিক্রি করার কথা, এখন ভোক্তাদের জিম্মি করে, বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সেটা ৪০ টাকা বেশি করবেন। এতে করে বাজার থেকে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা মজুদদারদের পকেটে চলে যাবে বলে প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি, গ্লোব অয়েল ও বসুন্ধরা গ্রুপের দেয়া তথ্যের সঙ্গে মাঠের চিত্র মিলিয়ে দেখব। যেখানেই তথ্যের গরমিল দেখা যাবে সেখানেই অভিযান চালানো হবে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি অভিযানে বেশকিছু পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার অসাধু ব্যবসার বিষয়টি চিহ্নিত হয়েছে।
এদিকে রবিবারের মতো সোমবারে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার লিটার সয়াবিন তেল খুঁজে পায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এছাড়া রবিবার সকালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ভার্চুয়াল বৈঠকে সংস্থাটির ৬৪ জেলা ও বিভাগীয় শহরের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়। সেই বৈঠক থেকে প্রতিটি জেলায় তালিকাভুক্ত ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে থাকা মজুদ ও কয়েক দিনের বিক্রির তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়। ভোজ্যতেল উদ্ধারে সংস্থাটি আরও কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করার পাশাপাশি মুদিপণ্যের বাজারে অভিযান পরিচালনা করবে।