কাজিরবাজার ডেস্ক :
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন যত বাড়ছে, তত বাড়ছে প্রতারকদের দৌরাত্ম্য। গ্রাহকদের মধ্যে প্রতি দশ জনে একজন প্রতারিত হচ্ছেন কোনও না কোনও সময়। বেশি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সিলেট বিভাগের বাসিন্দারা। প্রতিনিয়ত অগণিত গ্রাহক প্রতারিত হলেও আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন খুব কম ভুক্তভোগী। এসব তথ্য জানিয়েছে ডিএমপি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
গত বছর মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত প্রতারণায় ৫১টি মামলা তদন্ত করেছে ওই ইউনিট। এর মধ্যে ৩৫টির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন। এসব অভিযোগপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতারিত ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতরাও রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার শিকার হওয়ার পর প্রতিকার না পাওয়া পর্যন্ত ৫০ শতাংশ গ্রাহক মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। অনিবন্ধিত সিম দিয়েই প্রতারণা হচ্ছে বেশি।
সম্প্রতি মিরপুরের ৬০ ফুট এলাকার প্রায় দেড় হাজার মানুষের ইউটিলি সার্ভিসের বিল আত্মসাৎ করেছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এক কথিত এজেন্ট। ওমর ফারুক নামের ওই প্রতারক র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে।
গ্রেফতারকৃত ফারুক একসময় ঢাকার মগবাজারের একটি বিকাশ এজেন্টের দোকানে কর্মচারী ছিল। পরে নিজেই মিরপুর এসে এজেন্ট সেজে টাকা আত্মসাৎ করে।
এছাড়া কাস্টমার কেয়ার সেজে, পুরস্কারের কথা বলে, অ্যাকাউন্ট সচল রাখার কথা বলে, নম্বর ক্লোনসহ আরও অনেক কায়দায় অর্থ আত্মসাৎ করছে প্রতারকরা।
বেশি ভুক্তভোগী সিলেটে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বেসরকারি পরিসংখ্যান বলছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশি হলেও সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার ৩০ শতাংশ সিলেট অঞ্চলের গ্রাহকরা। সবচেয়ে কম প্রতারণার শিকার ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষ। প্রতারিতদের ৬ শতাংশ ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের বাসিন্দা।
পুলিশ দাবি করেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতারণার সঙ্গে ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাগুরা ও খুলনা বিভাগের কিছু জেলার লোকজন বেশি জড়িত।
প্রতারকরা অনেক সময় সংঘবদ্ধ হয়েও কোনও ব্যক্তিকে টার্গেট করে এ অপরাধ করে। অন্যের নামে বা ভুয়া নিবন্ধিত সিম দিয়েই মূলত প্রতারণা করে তারা।
দশ জনে একজন
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন গ্রাহক কোনও না কোনও সময় মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত প্রতারণার শিকার হন।
প্রতারণার শিকার হয়ে ওই গ্রাহকরা অপারেটর পরিবর্তন করেন। অথবা কেউ কেউ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনই বন্ধ করে দেন।
নারী বেশি প্রতারিত
পিআরই’র গবেষণায় আরও দেখা গেছে, প্রতারণার শিকার একজন নারী গ্রাহক গড়ে ৯ হাজার ১৫৯ টাকা এবং পুরুষ গ্রাহক ৮ হাজার ৭৮২ টাকা খুইয়েছেন।
মামলায় অনীহা
প্রতারিত গ্রাহকরা অল্প টাকা খোয়ালে আর মামলা করতে চান না। মোটা অঙ্কের টাকা হলেই কেউ কেউ মামলা করেন।
অনেক সময় শুধু কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিয়েই চুপ থাকেন গ্রাহক।
সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ জানিয়েছে, গত বছর সংস্থাটি ৫১টি মামলা পেয়েছে। এসব মামলায় ৪৫ প্রতারককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিং ঘিরে ১৫ অপরাধ
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, ১৫ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অর্থ লেনদেনে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করা হয়।
অপরাধগুলো হলো মাদক ব্যবসা, মানবপাচার, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, হত্যা, অপহরণ, হুন্ডি, জালিয়াতি, জিনের বাদশা, হ্যালো পার্টি, প্রতারণা, মুক্তিপণ আদায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকা আদায় ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড।
ধরা পড়ছে যেভাবে
থানা-পুলিশ ছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতারণা ও অবৈধ লেনদেন চিহ্নিত এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে পাঁচটি ইউনিট। এই ইউনিটগুলো হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মো. তারেক বিন রশীদ বলেন, ‘আমরা যখনই অভিযোগ পাচ্ছি, ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রতারণার শিকার হলে অবশ্যই সবার আইনগত প্রতিকার নেওয়া উচিত। তাহলে প্রতারকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সহজ হবে।’