মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান :
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়, কুরআনে সূরা আত্তাওয়াবার ৩৬নং আয়াতে সেই এক বৎসর বার মাসে গঠিত হয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট মাসমূহের সংখ্যা হচ্ছে ‘বারো’, ইহা আল্লাহর গ্রন্থে লেখা’’।
চান্দ্র বৎসরের বার মাসের মধ্যে শুধু রমজান মাসের নাম কুরআনে উল্লেখ আছে। সুরা আল-বারাকার ১৮৫নং আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- “রমজান সেই মাস, যাতে কুরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। যে কুরআন মানব জাতির পথ প্রদর্শক এবং যাতে সঠিক পথের নিদর্শনসমূহ প্রদত্ত হয়েছে এবং যা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী। অতএব এই মাস যারা প্রত্যক্ষ করবে তাদেরকে সিয়াম পালন করতে হবে। আর যদি কেহ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণ অবস্থায় থাকে, তবে সে যেন অন্যান্য দিনে এই সিয়ামের সংখ্যা পূর্ণ করে লয়। বস্তুত আল্লাহ তোমাদের কাজ সহজ করে দিতে চান, কোনরূপ কঠোরতা আরোপ করা আল্লাহর ইচ্ছা নেই। তোমাদেরকে এই জন্য বলা হচ্ছে যে, তোমরা সিয়ামের সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে সত্য পথের সন্ধান দিয়েছেন সেই জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পার’’।
এই মাসে আল্লাহ তা’য়ালা মুসলমানদের উপর সিয়াম ফরয করে দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে সূরা আল-বাকারা, আন নিসা, আল মায়িদা, মারিয়ম, আল আহযাব ও আল মুজাদালাহ এই ছয়টি সূরায় মোট চৌদ্দবার সিয়াম শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। তবে সিয়ামের বিধান সম্বলিত আয়াতগুলোর একত্র সমাবেশ ঘটেছে সূরা আল-বাকারায়। তাছাড়া সহীহ্ হাদীস গ্রন্থগুলোতে সিয়ামের মাহাত্মা, মর্যাদা ও বিধি-বিধান সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনে সূরা আল বাকারার ১৮৩ ও ১৮৪ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- “হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে। যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। যেন তোমরা তাকওয়ার গুণে ভূষিত হতে পার। অল্প কয়েকদিনের জন্য মাত্র তোমাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ থাকলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় হিসাব গণনা করে সিয়াম রাখবে’’।
কুরআনের সূরা আল বাকারায় যে অংশে আল্লাহ সুবহানু তা’য়ালা রমজান ও সিয়াম প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন সেখানে তিনি আরও বলেছেন, “যখন তোমার কাছে আমার কোন বান্দা আমার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করবে তখন বলে দিবে আমি তো নিশ্চিতভাবেই তোমাদের নিকট অবস্থান করছি। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা শুনে থাকি। অতএব তাদের উচিত আমার ডাকে সাড়া দেওয়া। যাতে করে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হতে পারে’’ (২:১৮৬)।
মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হলো কুরআনের আলোকে জীবন ও সমাজ গড়া। এ কাজের জন্যে আল্লাহ নিজেই তাকওয়াকে শর্ত বানিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “এই কুরআন আল্লাহর কিতাব এতে কোনই সন্দেহ নেই, আর এটি পথের দিশারী তাঁদের জন্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী’’ (২:২)।
আদম (আ:) থেকে নূহ (আ:) পর্যন্ত প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে যে সিয়াম ফরজ ছিল, তাকে বলা হয় ‘আইয়ামে বীয’ (উজ্জ্বল দিন) এর রোজা। মহররমের দশ তারিখে অর্থাৎ আশুরার সিয়াম হলো মুসা (আ:) এর শুকরানা সিয়াম। এ দিনে আল্লাহ তা’য়ালা মুসা (আ:) ও তাঁর অনুসারীদিগকে ফিরআউন ও তার সৈন্যদের আক্রমণ হতে রেহাই দিলেন এবং ফিরআউন ও তার সমস্ত সৈন্যদেরকে পানিতে ডুবিয়ে মারলেন (বুখারী, মুসলিম)। ইহুদী ও খৃষ্টানদের উপর যে ৪০ দিন উপবাস ফরয তাকে খবহঃ বলা হয়। অবশ্য খৃষ্টানদের খুব কম লোকই এই উপবাস পালন করে। মুসলমান ও আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও নাসারা) সিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হলো, মুসলমানরা সেহরী খায় আর আহলে কিতাবরা তা খায় না (মুসলিমÑ। আল্লাহ কর্তৃক যেসব ধর্মমত প্রেরিত হয়নি তাদের মধ্যেও কোন না কোন ভাবে প্রাচীনকাল থেকে উপবাসের বিধানের খবর পাওয়া যায়। নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের দ্বিতীয় সালে মুসলমানদের উপর একমাস সিয়াম ফরয করা হয়। আল-কুরআনের বর্ণনা-“যেরূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর’’। এতে সিয়ামের ঐতিহাসিক সত্যতাই প্রমাণ করে।’’
বলা হয়, কল্ব যখন ভাল থাকে তখন শরীরও ভাল থাকে, আর কল্ব যখন বিকৃত হয়ে পড়ে তখন শরীরও বিকৃত হয়ে পড়ে। এই কল্বকে ভাল রাখবার জন্যই ইসলামে সিয়াম, সালাত ও যিক্র পদ্ধতির ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সিয়ামের স্থান ঊর্ধ্বে। কারণ সিয়াম দ্বারা মানুষ মুত্তাকী হতে পারে। আল্লাহর গুণে সর্বাধিক গুণান্বিত হবার বাস্তব অনুশীলন হচ্ছে সিয়াম সাধনা। ইসলামের যে পাঁচটি স্তম্ভ আছে তার মধ্যে সিয়ামকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করা হয়। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-“সিয়াম খাস আমার ভয়ে হয়। এর বদলা আমি নিজে দিব’’ (বুখারী, মুসলিম)।
ধনী-দরিদ্র সকল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর উপর সিয়াম ফরয। এই সিয়াম পালন ছাড়া সালাত, যাকাত, হজ্ব এমনকি কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না’ (সিয়াম ও তারাবীহ-আবু মুহাম্মদ আলীমুদ্দীন, ১৩৯৯ হি:)। ধন ও মালের যেমন যাকাত আদায় করতে হয় ঠিক তেমনি সিয়াম শরীরের যাকাত স্বরূপ।
রোজা ফার্সি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ‘উপবাস’। প্রচলিত রোজা শব্দটি আরবী ‘সিয়াম’-এর স্থান অধিকার করছে। নিছক উপবাস সিয়ামের প্রতিশব্দ নয়। ‘রময’ শব্দ হতে রামাযানের উৎপত্তি। এর বুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘দাহন’ বলা যায় অসৎ প্রবৃত্তির দাহন’। কেহ কেহ বলে থাকেন যে, ‘রামাযান’ আল্লাহর অন্যতম নাম, অতএব উহা বুৎপত্তি সিদ্ধ নয়। এই প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ, দেহলভী (র:) বলেছেন, “যেহেতু পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতা-সুলভ চরিত্র অর্জনের পক্ষে অন্তরায়, সুতরাং এর প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। অতএব এই উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করা হচ্ছে সিয়ামের সূক্ষ্ম তাৎপর্য’’। আরবীতে আমরা যাকে ‘সওম’ বলি তার বহুবচন হলো ‘সিয়াম’। শব্দটির মৌলিক অর্থ ‘বিশ্রাম লওয়া’ ‘বিরত থাকা’। শরীয়তে এর অর্থ আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদিকের প্রারম্ভ হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয় চর্চা হতে বিরত থাকা। কাজেই স্পষ্টই বোঝা যায় সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পাশবিক প্রবৃত্তি দমন। সিয়ামের মাধ্যমে তা সম্ভব বলে যুগে যুগে নবী-রসূলগণ ওহী লাভের প্রাক্কালে সিয়াম পালন করতেন।
রমজান মাস মুসলিম বিশ্বে অতি পবিত্র মাস। এই মাসে আল্লাহ তা’য়ালা বেহেশতের দরজা খুলে দেন আর দোযকের দরজা বন্ধ করে দেন। এই মাসের মর্যাদা এই জন্য বেশি যে, আসমানী কিতাবের প্রায় সবগুলো এই মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআন শরীফ ছাড়া ইবরাহীম (আ:) এর সহীফা, দাউদ (আ:) এর যাবুর, মুসা (আ:) এর তাওরাত এবং ঈসা (আ:) এর ইঞ্জিল এই রামাদ্বান মাসেই অবতীর্ণ হয়। ঈসা (আ:) তাঁর মা মরিয়মের গর্ভে আল্লাহর এক মহান কুদরতী নিদর্শন-স্বরূপ জন্মগ্রহণ করেন। যেদিন তিনি ভূমিষ্ঠ হন সেদিন তাঁর মা রোযা ছিলেন (সূরা মরিয়াম : ২৬)। বুখারী আবু হুরায়রা (রা.) এর বাচনিক, নাবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়ামকে এমন এক ঢাল হিসাবে বিবৃতি করেছেন যা ইহকালে মানুষকে মন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং পরকালে দোযখের আগুন হতে বাঁচিয়ে রাখে। বায়হাকী সালমান ফারসী (রা:) প্রমুখাৎ রেওয়ায়েত করেছেন যে, নাবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের শুরুতে এবং শাবান মাসের শেষতম দিবসে তাঁর অভিভাষণে বলেছেন, “হে জনমন্ডলী! একটি মহান বরকতপূর্ণ মাস তোমাদের উপর ছায়ার মত এসেছে। এটি এমন মাস যার একটি রাত এক হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম। এই মাসের সিয়াম আল্লাহ ফরজ করেছেন’’ (মিশকাত)।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তৃতীয় বুনিয়াদ হচ্ছে রমজান মাসের সিয়াম। সিয়াম যাদের উপর ফরয তারা যদি বিনা কারণে একটি সিয়াম ইচ্ছাকৃত ভাবে না করে তাহলে সারা জীবন সিয়াম রাখলে ওই বিনা কারণে ইচ্ছাকৃত ভাঙ্গা সিয়ামটির কাফ্ফারা হবে না (তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, আহমদ, মেশকাত)
উল্লেখিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায় রামাদ্বানের সিয়ামের গুরুত্ব কত বেশি। সিয়ামের আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক গুরুত্ব বিবরণ করতে যেয়ে নাবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, “এই মাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম দশদিন আল্লাহর রহমত নাযিলের, মধ্যবর্তী দশদিন ক্ষমা ও গুনাহ মাফের এবং শেষতম দশদিন দোযখ হতে মুক্তি পাবার সৌভাগ্যকাল’’ (বায়হাকী)।
তিনি আরও বলেছেন, “মানুুষের প্রতিটি ভাল কাজের প্রতিফল দশ হতে সাত শত গুণ বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু সিয়ামের প্রতিফল অগনন’’ (বুখারী, মুসলিম। নাবীজী আরও বলেছেন, “সিয়াম পালনকারীর উদ্দেশ্যে দুটি আনন্দকে তাদের ভাগ্যের জন্য নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, সিয়াম পালনকারী যে আনন্দ ইফতারের সময় লাভ করে থাকে। দ্বিতীয়, কিয়ামতের দিন স্বীয় প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময় যা সে অনুভব করবে’’ বুখারী, মুসলিম)।
ইমাম গায্যালী (র.) সিয়ামকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন :
সাধারণ লোকদের সিয়াম : পেট ও কাম রিপু হতে বিরত থাকাই সাধারণ লোকদের সিয়াম।
মধ্য শ্রেণীর লোকদের সিয়াম : হাত, পা, চোখ, কান, মুখ ও অন্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে পাপ কাজ হতে বিরত রাখা।
তৃতীয় শ্রেণীর লোকদের সিয়াম : এরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকদের কাজের সঙ্গে সঙ্গে দিলের সিয়ামও পালন করেন। নাবী, সিদ্দীক ও আল্লাহর নিকটবর্তীরা এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত।
সিয়াম দ্বারা মানুষ শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করে, এটাই ইসলামের শিক্ষা। কাম, ক্রোধ, লোব, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রিত করাই সিয়ামের বিশেষ উদ্দেশ্য। এই ষড়রিপুই মানুষের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। শুধু ইসলামের নয় সব ধর্মেরই নির্দেশ আছে এই রিপুগুলো নিয়ন্ত্রণ করবার। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, “প্রত্যেক বস্তুর যাকাত (পরিশোধক) আছে, আর দেহের যাকাত হলো সিয়াম’’ (ইবনে মাজাহ ও মিশকাত)। ষড়রিপু দমন করা ইসলামের শিক্ষা নয় বরং এইগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করাই ইসলামের শিক্ষা। সংসার ত্যাগ করে বনে জঙ্গলে বাস করবার মত কষ্টসাধ্য রীতি চালু আছে। ইসলাম ষড়রিপুকে ‘বস্তু শরীরের’ দাবী বলে স্বীকার করে কিন্তু এর দমন নয় বরং শরীয়তের সীমার মধ্যেই এদের নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের কর্তব্য।
মানব জীবনে চারটি জিনিসের চাহিদা খুবই মৌলিক ঃ ১. ক্ষুধা নিরাবরণের চাহিদা ২. তৃষ্ণা নিবারণের চাহিদা ৩. প্রজনন ক্রিয়ার চাহিদা ৪. বিশ্রাম গ্রহণের চাহিদা।
এগুলোর ন্যায়সঙ্গত চাহিদা পূরণের দ্বারা মানব জীবন সুন্দর, মার্জিত ও উৎকর্ষমন্ডিত হয়। এগুলোর চরম স্বল্পতা জীবনকে স্থবির, পঙ্গু ও অথর্ব করে দেয়। আবার এসবের ব্যাপারে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি জীবনকে লাগামহীন ও বেপরোয়া করে তোলে এবং পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়। ইসলাম এই মৌলিক চাহিদার বিজ্ঞান সম্মত ও ন্যায়সংগত বাস্তবায়নের দ্বারা মানব চরিত্রকে সর্বাধিক সুন্দর করে গড়ে তুলতে আগ্রহী এবং এই কাজে সিয়ামের ভূমিকা সর্বাধিক।
রামাদ্বান মাসটি গোটা বিশ্বের ১৩০ কোটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত বরকতময় মাস। এ মাস হচ্ছে আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর নৈকট্য, নেয়ামত ও রহমত লাভের মাস। রামাদ্বান মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানগণ দৈনন্দিন চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, পোষাক পচ্ছিদ, নিদ্রা, ইবাদত-বন্দেগী, সেহরী ও ইফতারী প্রভৃতিতে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চলার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। সারা দুনিয়ার মুসলমানগণ সিয়াম রাখার জন্য মানসিকভাবে তৈয়ার হয়ে যায়। সুতরাং রামাদ্বান মাসের আগমন প্রতিটি মুসলমানের হৃদয় আলোড়িত হয় এবং ফরয, সুন্নত, নফল ইবাদত ও দান খয়রাত প্রভৃতির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশের অনেক হাফেজ কিয়ামুল লাইল তারাবী সালাতে পবিত্র কুরআন খতম করার জন্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুসলমানরাও সিয়াম পালন করে থাকেন। এখন আমরা কতগুলো মুসলিম ও অমুসলিম দেশের সাথে পরিচিত হবো এবং জানতে চেষ্টা করব কিভাবে তারা সিয়াম ব্রত পালন করে থাকেন।
আমেরিকা : গোটা বিশ্বের পাওয়ার হাউস বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখানে আছে প্রায় ৭০ লাখ মুসলমান। বেশীর ভাগ মুসলমান বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ইলিনয়েস, ইস্তিয়ানো, মিসিগান. টেক্সাস, ভার্জিনিয়া, মেরিল্যান্ড রাজ্যগুলোতে। রামাদ্বান মাসে এশিয়ান মুসলিমগণ যারা এখানে বসবাস করেন তারা তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পায়জামা, পাঞ্জাবী, কাবুলি সেট কোর্তা পরিধান করেন এবং মহিলারা ও শিশুরা মেহেদি দিয়ে হাত রং করেন। অন্যদিকে আফ্রিকান মুসলিমগণ যারা এখানে থাকেন তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে থাকেন। সিয়ামকে কেন্দ্র করে আমেরিকার বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন বিশেষ কর্মসূচি পালন করে। যেমন, আমেরিকানা মুসিলম এলিমান্স, আমেরিকানা আরব এন্টি ডিসক্রিমিনাশন, আমেরিকান মুসিলম কাউন্সিল, মুসলিম পাবলিক এফিয়ারস কাউন্সিল, কাউন্সিল অফ আমেরিকান ইসলামিক রেলাশন, এ সমস্ত সংগঠন সিয়ামের সময়সূচী ও তাৎপর্য, ফোন, ই-মেইল, লেকচার, সেমিনার, স্থানীয় মিডিয়া ইত্যাদিতে প্রচার করে থাকে। আমেরিকাতে ইফতার সামগ্রীর মধ্যে খেজুর, খোরমা, সালাদ, পনির, রুটি, ডিম, মাংস, ইয়াগার্ট, হট বিনস, সুপ, চা ইত্যাদি থাকে। আমেরিকায় ২০০২ সালে প্রথম বারের মত রামাদ্বান ও ঈদ উপলক্ষে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে। গত ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারের সন্ত্রাসী ঘটনার পরে আমেরিকার মুসলমানদের উপর শুরু হয় মারাত্মক ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব। রামাদ্বান মাসে হোয়াইট হাউসে ইফতার পার্টি প্রথম শুরু করছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এটা বর্তমানে একটি প্রথা হয়ে দাড়িয়েছে। গত বছর প্রেসিডেন্ট রামাদ্বান মাসে হোয়াইট হাউসে ৫৩টি দেশের মুসলিম প্রতিনিধিদেরকে আমন্ত্রণ করে ইফতার পার্টি আয়োজন করেন। অনেক অমুসলিম এই মহাপবিত্র বরকতময় মাসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হচ্ছেন। এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর অনুগ্রহে ক্রমশই আমেরিকানগণ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থান আমেরিকাতে তৃতীয় স্থান। অনেক গবেষক মনে করেন অচিরেই তা দ্বিতীয় স্থান দখল করবে ইনশাআল্লাহ।
কানাডা : উত্তর আমেরিকার সম্পদশালী দেশ কানাডায় উল্লেখযোগ্য মুসলমান বসবাস করেন। বিগত ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য এদেশের মুসলমানদেরকেও সহ্য করতে হয়েছে বর্ণ বৈষম্য। রাজধানী অটোরায় সর্বাধিক মুসলমান বসবাস করে, সংখ্যা প্রায় ষাট হার্জা অটোয়া ছাড়াও সাসকেচুয়ান, অল্টারিও, সিনেটোবা, টরেন্টো, কুইবেক রাজ্যগুলোতে মুসলমানগণ বসবাস করেন। রামাদ্বানে ইফতার পার্টির আয়োজন চলে মহাসমারোহে এবং প্রতি শনিবার অটোয়া ইসলামিক সেন্টারের ইফতার পার্টিতে দেশ বিদেশের অসংখ্য মুসলমান হাজির হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথীয়দের জন্য ‘দ্যা মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন ইফতার পার্টির আয়োজন করে। ইফতারীতে খেজু, খোরমা, পনির, সালাদ, ফল, সুপ, জুস, রুটি, ডিম, মাংস, চা-কফি ইত্যাদি থাকে।
ইতালী : ইউরোপ মহাদেশের শেষ প্রান্তে এবং আটলান্টিক মহাসাগরের কিনারায় অবস্থিত ইতালী দেশটির শিক্ষিতের হার ৯৮%। দেশটির অধিকাংশ অধিবাসী ক্যাথলিক খৃষ্টান, তাছাড়া বৌদ্ধ ও ইহুদী আছে। সমগ্র জনসংখ্যার ১% হলো মুসলমান। এই অল্পসংখ্যক মুসলমান রামাদ্বানকে ঘটা করে স্বাগত জানায়। ইফতারীতে তারা বার্গার জাতীয় খাদ্য, নানাবিধ ফল যেমন- মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, বিভিন্ন ফলের রস খান। সেহরীতে বার্গার ও বার্গার জাতীয় খাদ্য বেশী পছন্দ করে থাকে। ইতালীর রাজধানী রোম। পবিত্র কুরআনে সূরা রোম নামে ৩০ নম্বরে একটি স্বতন্ত্র ৬০ আয়াত বিশিষ্ট সূরা নাযিল হয়েছে। রাসুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনে রোমক ও পারস্যিকদের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধের কাহিনী উক্ত সূরায় বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানে রোমকে বলা হয় নীরব শহর, শান্তির শহর, সাত পাহাড়ের শহর এবং পোপের শহর। (অসমাপ্ত)