কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রতি বছরই বর্ষার আগে এবং পরে দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। তবে এ বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে এবং মার্চের মাঝামাঝি থেকে তা বেশ ব্যাপকহারে বাড়তে শুরু করেছে।
ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও আগের যেকোনো বছরের চাইতে বর্তমানে বেশি।
মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) দুপুর ২টা পর্যন্ত রাজধানীর আইসিডিডিআরবিতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ) ৬৪৩ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগের দিন সোমবার (১১ এপ্রিল) গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ভর্তি হয়েছিল এক হাজার ১৫৪ জন রোগী। এবছরের ৪ মার্চ একদিনে সর্বোচ্চ এক হাজার ৩৮৩ জন রোগী ভর্তি হয় আইসিডিডিআরবিতে।
আইসিডিডিআরবিতে ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। বাড়তি রোগীদের চিকিৎসার জন্য টানানো হয়েছে বাড়তি দুটি তাঁবু। শুধু ঢাকার আইসিডিডিআরবি নয়, দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইসিডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ ডায়রিয়া, এর প্রতিকার কি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, ডায়রিয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দূষণযুক্ত পানি। এবারেও তেমনটাই ঘটেছে। আরেকটি কারণ বলা যায়, এবারের দীর্ঘ খরা। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে, পানি কমতে থাকলে দূষণের মাত্রা আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। অত্যধিক গরম পড়লে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পানি বেশি খায়, আর দূষণযুক্ত পানি পান করলে ডায়রিয়া অনিবার্য।
তিনি আরও বলেন, ভৌগোলিকভাবে ডায়রিয়া কে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। একটা হচ্ছে শহরের মানুষের ডায়রিয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল, যেখানে লবণাক্ততার কারণে মানুষ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করতে পারে না। পুকুর বা অন্য কোনো জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে। খরা হলে পুকুর বা জলাশয়ের পানীয় কমে যায়। এসব পুকুর বা জলাশয় একজন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর কাপড়-চোপড় যদি ধোয়া হয়, পরবর্তীতে যারা এই জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে তারাই ডায়রিয়ার ঝুঁকিতে থাকে। ঝুঁকিটা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। আরেকটি হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চল যেখানে ঝর্ণার পানি ব্যবহার করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে অনেক ঝর্ণা থেকে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে পানির প্রাপ্যতা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা যেখানে, যে পানি পায় সেই পানিই গ্রহণ করে। সেই পানি যদি দূষিত হয়, সেখানে যদি ডায়রিয়া বা কলেরার জীবাণু থাকে তাহলে তাদেরও ডায়রিয়া হবে।
আইসিডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির বলেন, ঢাকার শহরগুলোতে প্রতি বছরেই দুইবার করে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। বিগত ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে দেখছি ঢাকায় ডায়রিয়া বা কলেরা আক্রান্তের বেশ কিছু হটস্পট রয়েছে। যেমন যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, বাড্ডা, মোহাম্মদপুরের বসিলা ও টঙ্গী এলাকায় সাধারণত নিম্নবিত্ত সংখ্যা বেশি। কেন সাধারণত বনানী কিংবা গুলশানে ডায়রিয়া বা কলেরা হয় না? গুলশান-বনানীতে ওয়াসার স্বাভাবিক সরবরাহকৃত পানি পায়, সেখানে পানি পেতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু ওই এলাকা গুলোতে অনেকেরই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। কেউ হয়তো মসজিদে কিংবা মাদ্রাসায় থাকে। তারা জলাশয়ের পানি ব্যবহার করে। এই জলাশয়গুলোতে ডায়রিয়া বা কলেরার জীবাণু থাকলে, তাদের ডায়রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে এসব নিম্নবিত্ত এলাকায় অনেকেই অবৈধভাবে বা চুরি করে পানির লাইন ব্যবহার করেন। কোনো জায়গায় ফুটো করে পাইপ লাগিয়ে পানি নেয়। এই পাইপগুলো অনেক জায়গায় লুজ থাকে। অবৈধ এই পাইপ যেন দেখা না যায়, সেজন্য বিভিন্ন ড্রেন বা ড্রেনের পাশ দিয়ে নেওয়া হয়। ফলে যখন সাপ্লাইয়ের পানি থাকে না, তখন ড্রেনের পানিও এই পাইপের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এসব পানিতে কলেরা এবং ডায়রিয়ার জীবাণু থাকে। আবার পানির যখন সাপ্লাই আসে তখন এই জীবাণুযুক্ত পানি আবার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে যায়। গ্যাসের স্বল্পতার কারণে তারা পানি অনেক সময় ফুটাতেও পারে না। এই দূষণযুক্ত পানি পান করার ফলে তাদের ডায়রিয়া ও কলেরা হয়।
অধ্যাপক ডা. বেনজির বলেন, সমাধান হচ্ছে স্থানীয় সরকারের হাতে। স্থানীয় সরকারকে তাদের নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে ডায়রিয়া বা কলেরার হটস্পট গুলোতে কেন তারা নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। প্রয়োজনে তাদের বিনা পয়সায় বিশুদ্ধ পানি দিতে হবে, বিনা পয়সায় পানির লাইন করে দিতে হবে। যেটা দিল্লিতে করা হয়েছে। আমাদের নিম্নবিত্ত এলাকাতেও এমন ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শহরের নিম্নবিত্ত এলাকায় আমরা যদি বৈধ ভাবে পানি দিতে পারি, তাহলে তারা অবৈধভাবে পানির লাইন নেবে না।
তিনি বলেন, হটস্পটগুলোতে ওয়াসার নজরদারি রাখতে হবে বিশেষ করে বর্ষার আগে এবং পরে পানি দূষণ বাড়ছে কিনা। দূষণ যদি বাড়ে তাহলে এসব স্থানে আপদকালীন পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব স্থানে অস্থায়ী ভিত্তিক বড় বড় পানির ট্যাংকে ওয়াসার গাড়িতে পানি সরবরাহ করতে হবে। এ এলাকাগুলোতে আমরা কলেরা ভ্যাকসিন দিতে পারি। হট স্পটগুলোতে কলেরা ভ্যাকসিন দিলে আগামীতে এখানে আর কলেরা হবে না। দক্ষিণাঞ্চলে যেহেতু লবণাক্ততা রয়েছে, তাই সেখানে লবণমুক্ত পানি গ্রামে গ্রামে সরবরাহ করা যেতে পারে। বিকল্প হচ্ছে সমুদ্রের পানি লবণ মুক্ত করে স্থানীয়ভাবে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা যেটা অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ করছে।
পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ে প্রয়োজনে ডিপ টিউবওয়েল পানি সরবরাহ ব্যবস্থা করা। এই ব্যবস্থাগুলো স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে করতে হবে। স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে শুধু রাস্তাঘাট বানালেই হবে না। পাশাপাশি তাদের জনস্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই ডায়রিয়া সমস্যার সমাধান হবে বলেও জানান সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বেনজির।