কাজিরবাজার ডেস্ক :
পবিত্র মাহে রমজানের আজ দশম দিবস, রহমতের দশকের সমাপ্তি, সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু হবে মাগফিরাতের দশক। কুরআন শরীফে এ মাসকে বলা হয়েছে কুরআন নাজিলের মাস। তাই এ মাসে বেশি বেশি করে কুরআন তেলাওয়াত করা, তাফসির পড়া এবং সে মতে আমল করে উদ্দীপ্ত হওয়া এ মাসের দাবি। আজ এ পর্যায়ে একটি সূরার পটভূমি নিয়ে আলোচনা করব। পবিত্র কুরআনুল করীমের ৭ম সূরা হলো সূরাতুল আ’রাফ। এটি মাক্কী সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ২০৬ এবং রুকু ২৪টি। এ সূরায় বিভিন্ন উদ্ধৃতি, কথোপকথনের মাধ্যমে বেহেস্তবাসীর অনন্ত ও অপরিমেয় সুখ-শান্তি আর দোজখবাসীর বিভিন্ন দুঃখ ও যাতনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ সূরার অধিকাংশ বিষয়বস্তুই পরকাল ও রিসালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চতুর্থ রুকুর অর্ধেক থেকে ষষ্ঠ রুকুর শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পরকালের আলোচনা রয়েছে। অতঃপর ৮ম রুকু থেকে ২১তম রুকু পর্যন্ত নবী-রাসূলগণ ও তাদের উম্মতের ব্যাপারাদি বর্ণিত হয়েছে। এগুলো সবই রিসালত সম্পর্কিত। এসব কাহিনীতে রিসালত বা নবীদের সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের শাস্তির কথাও বর্ণিত হয়েছে- যা থেকে বর্তমান অবিশ্বাসীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। ২২তম রুকুর অর্ধেক থেকে ২৩ রুকুর শেষ পর্যন্ত পরকাল সম্পর্কিত বিষয়ের পুনরালোচনা এসেছে। শুধু ৭ম ও ২২তম রুকুর শুরুতে এবং সর্বশেষ ২৪তম রুকুর বেশিরভাগ অংশে এসেছে তাওহীদ সম্পর্কে বিশেষ আলোচনা। শেষাংশে নবী করীম (স.) এবং তার সঙ্গী-সাথীদের প্রচার পদ্ধতিতে অনুসৃত বিশেষ বিজ্ঞানসম্মত পন্থা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হেদায়াত দেয়া হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীদের উত্তেজনা দান ও অত্যাচারমূলক কর্মতৎপরতার মোকাবেলায় অত্যন্ত ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ এবং ভাবাবেগের বন্যা-প্লাবনে ভাসিয়ে গিয়ে আসল উদ্দেশ্য লক্ষ্যের পরিপন্থী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্য সবিশেষ নসিহত করা হয়েছে।-(তাফ, মাআরিফ, বয়ানুল কুরআন)।
এ সূরার নাম রাখা হয়েছে ‘আল-আরাফ’। সূরাটির ৫ম রুকুর এক জায়গায় ‘আসহাবুল আ’রাফ’-আরাফবাসীর কথা উল্লেখ করা হয়। এর দরুন এরূপ নামকরণের অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এটি এমন একটি সূরা-যাতে আরাফবাসীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায় যে, আরাফবাসী হলো সেই সব লোক- যারা ইতিবাচকভাবে যেমন জান্নাতে প্রবেশের যোগ্য বিবেচিত হবে না, তেমনি তাদের নেতিবাচক দিক এতদূর নৈরাজ্যজনক ও ব্যর্থতাপূর্ণও হবে না যে, তাদের দোজখেই নিক্ষেপ করা অপরিহার্য হয়ে পড়বে। এ কারণে তারা বেহেস্ত ও দোজখের মধ্যে অবস্থিত এক সীমান্ত এলাকায় বাস করবে। তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনে এ সম্পর্কে ব্যাখ্যায় এসেছে : জান্নাতী ও দোজখীদের মাঝামাঝিতে এমন কিছু লোক থাকবে যারা দোজখ থেকে মুক্তি পাবে, কিন্তু তখনও জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করার আশা পোষণ করবে। তাদেরই আরাফবাসী বলা হয়। সূরা হাদীদের আয়াত থেকেও এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন হাশরের ময়দানে তিনটি দল থাকবে। ১. সুস্পষ্ট কাফির ও মুশরিক। এদের পুলসিরাতে চলার প্রশ্নই উঠবে না। এর আগেই জাহান্নামের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। ২. মুমিনের দল, তাদের সঙ্গে ইমানের আলো থাকবে। ৩. মুনাফেকের দল- এরা দুনিয়াতে মুসলমানদের সঙ্গে লাগা থাকত। সেখানেও প্রথম দিকে সঙ্গে লেগে থাকবে এবং পুলসিরাতে চলতে শুরু করবে। তখন একটি ভীষণ অন্ধকার সবাইকে ঘিরে ফেলবে। মুমিনরা ইমানের আলোর সাহায্যে সামনে এগিয়ে যাবে। মোনাফেকরা ডেকে ডেকে তাদের বলবে : একটু আস, আমরাও তোমাদের আলো দ্বারা একটু উপকৃত হই।’ তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন ফেরেস্তা বলবে : পেছনে ফিরে যাও এবং সেখানেই আলো তালাশ কর।’ উদ্দেশ্য এই যে, এ আলো হচ্ছে ইমান ও সৎকর্মের। এ আলো হাসিল করার স্থান পেছনে চলে গেছে। যারা সেখানে ইমান ও সৎকর্মের মাধ্যমে এ আলো অর্জন করেনি, তারা আজ আলো দ্বারা উপকৃত হবে না। এমতাবস্থায় মুমিন ও মোনাফেকদের মধ্যে একটি প্রাচীর বেষ্টনী দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে। এতে একটি দরজা থাকবে। দরজার বাইরে থেকেই আজাব দৃষ্টিগোচর হবে এবং ভেতরে মুমিনরা থাকবে। তাদের সামনে আল্লাহর রহমত এবং জান্নাতের মনোরম পরিবেশ বিরাজ করবে। ইবনে জরির ও অন্যান্য তাফসিরের মতে, সংশ্লিষ্ট আয়াতে ‘হিজাব’ শব্দটি উল্লেখ করে প্রাচীর বেষ্টনীকেই বোঝানো হয়েছে। প্রাচীর বেষ্টনীর উপরিভাগই হয়ে থাকে আরাফ। বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আরাফ অবস্থানকারীরা এবং জান্নাত ও দোজখবাসী সবাই এক পক্ষ অন্য পক্ষের অবস্থা নিরীক্ষণ করবে এবং পরস্পর প্রশ্নোত্তর ও কথাবার্তা বলবে। তাদের দৃষ্টি হবে সূক্ষ্ম ও দূরদর্শী। সেখানে শব্দ ও শ্রবণশক্তি এত ব্যাপক ও বড় মানের হবে যে, বিভিন্ন জগতের এ লোকেরা অনায়াসে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে ও শুনতে পাবে।
আসলে পবিত্র কুরআনের বাণী ও আয়াতের পটভূমিগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত জীবন ও জগত সম্পর্কে সতর্ক করে তোলে। তাই জরুরী এসবের সম্যক জ্ঞানাহরণ।