কাজিরবাজার ডেস্ক :
আজ ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৯৭১ সালের এদিনে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনের ৫১ বছর পূর্তির দিনও আজ।
১৯৭১ সালের এদিন মানুষের প্রতি মমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সরকার গঠনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (প্রোক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) পাঠ করা হয়। এদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকেও অনুমোদন করা হয়। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
এর ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায় এই সরকার শপথ গ্রহণ করে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথ তলার নামকরণ করেন ‘মুজিবনগর’। সেই থেকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিবনগর’ সরকার নামে পরিচিত হয়। এই সরকারের নেতৃত্বে পুরো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ঘোষণায় বলা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণ দেন। এ ভাষণ অবরুদ্ধ দেশবাসীকে আরও সাহস জোগায় ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উজ্জীবিত করে। প্রধানমন্ত্রী তার এ ভাষণে বলেন, আমাদের এ মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে স্থির বিশ্বাস। প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বাড়ছে। আর এ সংগ্রাম বিশ্ববাসীর স্বীকৃতি লাভ করছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে প্রবাসী সরকারের এক অধ্যাদেশে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।
সদ্য প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের নির্বাচিত জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি গোপন স্থানে মিলিত হয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেন। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম পরে তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন।
মন্ত্রী সভার অন্য সদস্যরা হলেন- এম মনসুর আলী (অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প) এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও কৃষি)। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি বেইমান খন্দকার মোশতাক আহমদও (পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ) মন্ত্রী সভার সদস্য ছিলেন।
১০ এপ্রিল সরকার গঠনের পর ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদ একটি বেতার ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। এছাড়াও ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ হয়।
মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদ্যনাথ তলায় শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শপথ গ্রহণের পরই তাজউদ্দীন আহমদ এ স্থানের নাম দেন ‘মুজিবনগর’। পরবর্তী সময়ে প্রবাসী সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে।
এদিকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীরা শপথ নিলেও ১৮ এপ্রিল মন্ত্রী পরিষদের প্রথম সভায় মন্ত্রীদের দফতর বণ্টন করা হয়। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এই প্রথম সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং ভারতসহ বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর চাপের মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২’র ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এর আগে ভারত এবং ভুটান এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড, কূটনৈতিক ও প্রচার ক্ষেত্রে বিশ্ব জনমত গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল অস্থায়ী এই সরকার। মুজিবনগর সরকার সফলতার সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই সরকারের দক্ষতার ফলেই মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তানীদের দখলমুক্ত হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। তাই ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয়, অমলিন একটি দিন।