আসন্ন রমজান মাসে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, ঈদুল ফিতরে উৎসব বোনাস প্রদান এবং ৮ ঘন্টা কর্মদিবস, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র প্রদানসহ শ্রমআইন কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দাবিতে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। ২০ মার্চ দুপুরে মৌলভীবাবাজার জেলা হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহিন মিয়া স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পেশ করা হয়। স্মারকলিপির অনুলিপি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন শ্রমঅধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহা-পরিদর্শকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পাশাপাশি হোটেল রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির নিকটও পেশ করা হয়। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় এপ্রিলের শুরুতেই রমাজন মাসের আগমন উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের চলমান ঊর্ধ্বমুখী বাজারে আরো চওড়া হওয়ার আশঙ্কা যেখানে বিদ্যমান সেখানে হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের সামনে রয়েছে ব্যাপক চাকুরিচ্যুতির আশঙ্কা। এমনিতেই সারা বছর হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুতি করা, স্বাস্থ্য সম্মত কর্মপরিবেশ ও থাকা-খাওয়ার সু-ব্যবস্থা না থাকা, কথায় কথায় বিনা কারণে চাকুরিচ্যুতি করা, নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র না দিয়ে শ্রম আইনগত সুবিধা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি সমস্যা-সংকট নিয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের জীবন-জীবিকা চালাতে হয়। তদোপুরি রমজান মাস আসলে আরেক দফা ছাঁটাই নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে শ্রমিকদের কর্মজীবনে। চলমান বৈশ্বিক মন্দাজনিত পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ সাল থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনা প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও শ্রমজীবীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিকরা। করোনাকালে হোটেল শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে, বিনা চিকিৎসায়, বাসস্থানের সংকট ইত্যাদিতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর সাধে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। আসন্ন রমজান মাসে যারা চাকুরিতে নিয়োজিত তাদেরকে আরেক দফা ছাঁটাই করা হলে তারা কোথায় যাবে? চাল, ডাল, তেল, লবণ, পিঁয়াজ, আদা, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। তাছাড়া প্রতি বছর দফায় দফায় জ¦ালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুত, পানির মূল্য বৃদ্ধিসহ বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, চিকিৎসা, শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির ফলে জাতীয় ও জনজীবনের সংকট প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধি হচ্ছে। অথচ বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে হোটেল-রেস্টুরেন্ট-মিস্টি-বেকারি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। আজকের বাজারদর হিসেব করলে দেখা যায় একজন মানুষের কোন রকমে খেয়ে বেঁচে থাকতে হলে তিন বেলা খাবারের জন্য দৈনিক (৪০+৮০+৮০)টাকা = ২০০ টাকা খরচ করতে হয়। সেখানে ৬ সদস্যের একটি শ্রমিক পরিবারে বাসাবাড়িতে খরচ হিসেবে দৈনিক এক হাজার টাকা ধরলে মাসে ৩০ হাজার টাকা প্রয়োজন। এর সাথে বাসাবাড়া, চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, বিনোদন, যাতায়াতসহ অন্যান্য সকল প্রয়োজন যুক্ত করেই মজুরি নির্ধারণ হওয়া যৌক্তিক। অথচ আমাদের নামে মাত্র মজুরি প্রদান করছে মালিকরা। তদোপরি রমজান মাস আসলে ব্যবসা মন্দার অজুহাত দেখিয়ে অধিকাংশ মালিকরা হোটেল রেস্টুরেন্ট মিস্টি বেকারী শ্রমিকদের বিনা বেতনে ছাঁটাই করে দেন। ফলে পবিত্র এই মাসে ছাঁটাইকৃত হোটেল রেস্টুরেন্ট মিস্টি বেকারী শ্রমিকদের জীবনে নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা, পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকরা সিয়াম সাধনার পরিবর্তে অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। এমনকি শ্রমিকরা ঈদের আনন্দ উদযাপন থেকেও বঞ্চিত হয়। অথচ শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে মালিকদের পুঁজি আরাম-আয়েশ বৃদ্ধি হয় আর শ্রমিকদের সৃষ্ট মুনাফায় মালিকপক্ষ মহাধুমধামে ঈদ উৎযাপন করেন। ঈদ উৎসবের সময় হোটেল রেস্টুরেন্ট মিস্টি বেকারী শ্রমিকরা কোন উৎসব বোনাস পান না। অথচ বাংলাদেশ শ্রমআইন-২০০৬(অদ্যাবধি সংশোধিত) এর ধারা ২(২ক) এবং বাংলাদেশ শ্রমবিধিমালা-২০১৫ এর বিধি ১১১(৫) অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিককে উৎসব বোনাস ও ছুটি প্রদান করা আইনত বাধ্যতামূলক। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ শ্রম আইন-এর ৫ ধারায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র, ৬ ধারায় সার্ভিস বই, ২(১০) ধারায় প্রতিবছর চাকুরীর জন্য ৪৫ দিনের গ্রাচুইটি, ২৬(ক) ধারায় চাকুরীচ্যুতি জনিত ৪ মাসের নোটিশ পে, ১০৩ ধারায় সপ্তাহে দেড়দিন সাপ্তাহিক ছুটি, ১০৮ ধারায় দৈনিক ৮ ঘন্টা সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা কাজ, অতিরিক্ত কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরি প্রদান, ১১৫ ধারায় বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি, ১১৬ ধারায় ১৪ দিন অসুস্থতার ছুটি, ১১৭ ধারায় প্রতি ১৮ দিন কাজের জন্য ১ দিন অর্জিত ছুটি, ১১৮ ধারায় ১১ দিন উৎসব ছুটি প্রদানের আইন থাকলেও আমাদেরকে এই সকল আইনগত অধিকার হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অথচ হোটেল মালিকরা সরকারী আইন লঙ্ঘন করে মনগড়া নিয়মে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। শুধু আইনগতভাবে নয় ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের দিক থেকেও হোটেল-রেস্টুরেন্ট-মিস্টি-বেকারি শ্রমিকদের রমজান মাসে বিনাবেতনে ছাঁটাই করা অন্যায়। হোটেল শ্রমিকরা দৈনিক ১২/১৪ ঘন্টা অমানবিক পরিশ্রম করে অর্ধাহারে-অনাহারে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন, যার কারণে হোটেল শ্রমিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। এমতবস্থায় স্মারকলিপিতে আসন্ন রমজান মাসে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, ঈদুল ফিতরে উৎসব বোনাস প্রদান এবং ৮ ঘন্টা কর্মদিবস, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র প্রদানসহ শ্রমআইন কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন শ্রমিকরা। বিজ্ঞপ্তি