অগ্নিঝরা মার্চ

7

কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০ মার্চ, ১৯৭১। ১৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পথে। বন্ধ হয়ে যায় সমঝোতার সমস্ত পথ। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা ছাড়া বাঙালির সামনে কোন পথ খোলা ছিল না। নরঘাতক জেনারেল টিক্কা খানরা গোপন বৈঠক করে নির্বিচারে বাঙালি নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে।
বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছয় শীর্ষস্থানীয় সহকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টায় বৈঠক শুরু হয়ে তা প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। বৈঠক থেকে বেরিয়ে সোজা ধানমন্ডির বাসভবনে যান বঙ্গবন্ধু। সেখানে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। চতুর্থ দফা বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা আরও হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছে- এই মর্মে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘বাংলাদেশের সব খবর আমার জানা আছে।’
বাঙালি বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় বসাটা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো, প্রহসন মাত্র। আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানে স্বৈরশাসকরা বাঙালিদের স্বাধীনতার সমস্ত আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার কৌশলে ব্যস্ত ছিল। এরই মধ্যে পাকস্তানী সামরিক জান্তারা নির্বাচনে বাঙালি নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হামিদ ও জেনারেল টিক্কা খানের এক বৈঠক থেকেই অপরেশন সার্চ লাইটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
একাত্তরের এদিন ধানমন্ডির বাসভবনে সমাগত জনতার উদ্দেশে একাধিক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন, মুক্তিপাগল সাড়ে সাত কোটি বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই রুখতে পারবে না। বাংলাদেশকে কলোনি করে বাজার হিসেবে ব্যবহার করার দিন শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সত্যাগ্রহ চলবে।
একাত্তরের ২০ মার্চ ছিল ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন। আন্দোলনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। এবারের সংগ্রাম প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে। আবালবৃদ্ধবনিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, সারাবিশ্বের স্বাধীন জাতি কীভাবে স্বীয় লক্ষ্য পানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
অসহযোগ আন্দোলনের ঊনবিংশ দিবসে একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এদিন বিহারী ও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালীর সংঘর্ষ হয়েছে মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।
সারাদেশে এক উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। ক্ষুব্ধ জনতা পথে নেমে আসে। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে দেশজুড়ে। কিন্তু তখনও পূর্ব পাকিস্তানবাসী বুঝতে পারেনি যে অতর্কিতেই তাদের ওপর চালানো হবে অপারেশন সার্চ লাইট। জেনারেল ইয়াহিয়া খান এদিন তার সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতির পূর্ণ রূপ দেন। ওদিকে প্রতিদিনই ৬ থেকে ১৭টি পর্যন্ত ফ্লাইটে পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও যুদ্ধের রসদ নিয়ে আনা হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। স্থল ও বিমানশক্তি দ্বিগুণ করে।
একাত্তরের এদিন ছাত্র ইউনিয়ন এক ভিন্ন রকমের কর্মসূচী পালন করে। তাদের উদ্যোগে গঠিত গণবাহিনী ১০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করে রাজপথে এক শোভাযাত্রা বের করে। এতে প্রতিটি সদস্য সেদিন ডামি রাইফেল নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ (সাবেক শিক্ষামন্ত্রী)। তাঁর নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা বের হয়। সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও (সদ্য সাবেক সিপিবি সভাপতি) সর্বক্ষণিক বিভিন্ন কর্মসূচী পালনে ও ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেদের সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।