ভাগ্য প্রক্রিয়া ও বরকতময় লাইলাতুল বরাত

8

সৈয়দ আল্লামা ইমাম হায়াত :

অনেক কিছু নিয়ে মানুষের জীবন। অনেক বিষয়ের সাথে সংযুক্ত এ জীবনের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা, সুপরিণতি কিংবা কুপরিণতি। কিছু স্থায়ী ও মৌলিক বিষয় যা অপরিহার্য এবং জীবনের চূড়ান্ত পরিণতি নির্ণয় করে আর কিছু অস্থায়ী বিষয় যা প্রয়োজনীয় তবে অস্থায়ীভাবে সুখ বা দুঃখ বা এ দুয়ের মিশ্রিত অবস্থা তৈরি করে। আর তাই ভাগ্যের অবস্থা ও স্বরূপ আছে। স্থায়ী বা চূড়ান্ত সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য, অস্থায়ী বা চলমান সুখ-দুঃখ।
জীবনসত্য বুঝতে পারা, সত্যের উৎসের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সত্যের আলোকে নিজেকে আলোকিত করতে পারা, জীবনের উদ্দেশ্য ও মর্ম উপলব্ধি করতে পারা, জীবন তথা সময়কে অর্থপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারা, জীবনের যথার্থ দিশারী খুঁজে পাওয়া ও যথার্থ জীবন সাথী লাভ করতে পারা, জীবনের দায়িত্ব-কর্তব্য বোঝার লক্ষ্যে উপনিত হওয়ার জন্য জ্ঞান-যোগ্যতা ও গুণাবলী অর্জন করতে পারা ও এর পরিপন্থী অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারা ইত্যাদি স্থায়ী, মৌলিক ও অপরিহার্য বিষয়গুলো হওয়া বা না হওয়া জীবনের আসল ভাগ্য বা চূড়ান্ত পরিচিতি ও পরিণতি নির্ণয় করে।
আবার ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য জীবনের উপকরণসমূহ লাভ করা, দয়াময় আল্লাহতাআলা কর্তৃক তাঁর প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত অধিকারসমূহ লাভ করা; জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও গতিশীলতার সুরক্ষা পাওয়া এবং জীবনের করণীয়গুলো সম্পাদনের সামর্থ্য ও সুযোগ অর্জন করতে পারা ইত্যাদি বিষয়গুলোও জীবনের বিকাশ, সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য একান্ত অপরিহার্য।
প্রথম বিষয়গুলো না পেলে জীবন পরিণতিতে মিথ্যা, আঁধার ও কলুষতায় শয়তানের জীবনে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয় বিষয়গুলো না পেলে জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। অধিকার-নিরাপত্তা-মর্যাদা হারিয়ে জুলুম-শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়, এমনকি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এ বিষয়গুলো কিসের উপর নির্ভর করে, কিভাবে পেতে হয় কিংবা কেন অনেকে বঞ্চিত থাকে তা বুঝতে না পারলে বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হতে হয়।
মূলত দোজাহানের সকল ভাগ্যের সূত্র ও উপকরণ একমাত্র দয়াময় আল্লাহতাআলার পক্ষ থেকে তা দান কিংবা শাস্তি যাই হোক। কিন্তু তা কোনমতেই খেয়ালীপনা বা নিয়মনীতিবিহীন নয়। এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় ন্যায় ভিত্তিক কারণ ও নিয়মনীতি, সুবিচারভিত্তিক পদ্ধতি-প্রক্রিয়া এবং অলঙ্ঘনীয় মাধ্যম। সব কিছু সৃষ্ট হওয়া এবং এরপর যে কোন দান, নেয়ামত তথা সকল রহমত নাজিল হওয়ার, বিতরণ হওয়ার, প্রাপ্ত হওয়ার একটা মূল অছিলা বা মধ্যস্থ আছে যাকে রাসুলে হাকিকী বলা হয় এবং এই রাসুলে হাকিকীই আমাদের প্রাণাধিক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম।
সকল রহমত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে হওয়ায় এবং সকল দান ও নেয়ামতের কেন্দ্র হওয়ায় কোরআন পাকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে রাহমাতাল্লিল আলামিন বা সর্ব জগতের সবার জন্য সবকিছুর জন্য রহমত। এ মূল মাধ্যমের অছিলায় জীবন অস্তিত্ব লাভ, গঠন ও বিকাশ হওয়ার, সমৃদ্ধ ও সফল হওয়ার, দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচার বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে দেয়া আছে এবং দেয়া হচ্ছে অবিরত।
যেমন দৈহিকভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার এবং এগিয়ে চলার মৌলিক উপকরণসমূহ মানুষকে বাইরে থেকে এবং ভিতর থেকে দেওয়া আছে, দেহের ভিতরে-বাইরে, পৃথিবীর ভিতরে-বাইরে বিভিন্নভাবে। আলো-বাতাস-পানি-তাপ-বিদ্যুৎ-শক্তি; এ দিকে ভূমি-খাদ্য-গাছপালা-খনিজ-অগ্নি-গ্যাস সহ বিভিন্ন পদার্থ দেয়া হচ্ছে বাইরে থেকে আর ভিতর থেকে চক্ষু-কর্ণ-বাকশক্তিসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এবং মেধা-বিবেক-কর্মশক্তি ইত্যাদি।
এরপর মানুষ যাতে জীবনের মর্ম ও সত্য উপলদ্ধি করে মিথ্যা, আঁধার ও কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে সৎ গুণাবলী বিকশিত করে সঠিক লক্ষ্যে চলতে পারে, আদর্শ ও সভ্য সমাজ গঠন করে অধিকার ও মর্যাদা সহকারে বাঁচতে ও বিকশিত হতে পারে এবং শোষণ-নিপীড়ন-পাশবিকতা-কুসংস্কার থেকে মুক্ত থাকতে পারে সে জন্য দয়াময় আল্লাহতাআলার নবীগণ এবং সবশেষে সকল নবীর মূলনবী বা নাবিয়ীল উম্মী আমাদের প্রাণাধিক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম মানুষকে দোজাহানে সৌভাগ্যের সুস্থ সঠিক জীবন ব্যবস্থার বাস্তব পথ দান করেছেন।
মেধা, শক্তি ও আল্লাহতাআলা প্রদত্ত উপকরণ ব্যবহার করে, জীবনকে সুন্দর ও সচ্ছন্দ করার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নির্দেশনা দিয়েছেন। বিশ্বের সর্বত্র দয়াময় আল্লাহতাআলা প্রদত্ত সব সম্পদ দুনিয়ার প্রতিটি মানুষ যাতে নায্য অধিকার মোতাবেক প্রাপ্ত হয়, সম্পদ যাতে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দেশের কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে অন্যরা বঞ্চিত শোষিত হয়ে না পড়ে তার স্পষ্ট সুব্যবস্থা দিয়েছেন। ভাষা-অঞ্চল-বর্ণ-অর্থ প্রভৃতি কৃত্রিম ভেদাভেদ করে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে যেন মানবতা ধ্বংস করা না হয় তার জন্যও যে সকল ব্যবস্থা দিয়েছেন সে ব্যবস্থার ওপর মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে।
বিশ্বের প্রতিটি মানুষ বোন-ভাই সবার উন্নত হওয়ার, মর্যাদা প্রাপ্তি, স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা-অর্থনৈতিকব্যবস্থা-সমাজব্যবস্থা-রাষ্ট্রব্যবস্থা দিয়েছেন; যে ব্যবস্থাবলীর ব্যত্যয় ঘটলে সমাজে নেমে আসে মিথ্যা ও অবিচারের আধিপত্য, বিধ্বস্ত হয় সভ্যতা, মানুষ হারায় তার প্রাপ্য অধিকার ও জীবনের গতি। এ হীন ব্যত্যয় শয়তানের দোসররা পবিত্র ইসলামের নামে পর্যন্ত ঘটিয়ে গোত্রতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ব্যক্তিক বা দলীয় স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এমনকি কতিপয় লোক আলেমের বেশেও এদের সমর্থন জানায়। দয়াময় আল্লাহতাআলা ও তাঁর প্রিয়তম রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম, মহামহিম প্রাণপ্রিয় আহলে বায়েত, মহামান্য খোলাফায়ে রাশেদিন, সত্যের ইমামবৃন্দ ও মহান জামিয়ে আওলিয়া কেরামের সাথে শহীদানের সাথে বেঈমানি বিশ্বাসঘাতকতা করে মিথ্যা ও জুলুমের পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতি করে সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে নিজেদের বিকিয়ে দেয় অপশক্তির কাছে। সত্যের ছদ্মনামে মানুষকে মিথ্যার দিকে ঠেলে দেয়; বিকৃত হয় দ্বীন, বিপন্ন হয় সমাজ।
এভাবে ভাগ্য প্রক্রিয়ার বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মানুষের জন্য সকল দান, রহমত ও সৌভাগ্য দয়াময় আল্লাহতাআলা ও তাঁর প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে কিন্তু তা পাওয়ার বা না পাওয়ার অনেক বিষয়ে অনেক কিছুতে ব্যক্তির উপর দায়িত্ব দেয়া আছে এবং অনেক কিছু সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা সঙ্গে সম্পর্কিত।
দুর্ভাগ্য আলাদা কিছু নয়। সৌভাগ্য ও এর অনুকূল উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত হওয়াই দুর্ভাগ্য সৃষ্টি করে। ব্যক্তিজীবনে দয়াময় আল্লাহতাআলা ও তাঁর প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত উদ্যোগ-চিন্তাশীলতা-বিবেক-মেধাশক্তির সুষ্ঠুব্যবহার, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন, মিথ্যা ও অনাচারের বিরুদ্ধাচারণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা কিংবা এর বিপরীতে উদাসীনতা, চিন্তা ও চর্চাহীনতা, মহামান্য খোলাফায়ে রাশেদিনের পথ-পন্থা থেকে বিচ্যুতি, ভ্রান্ত মত-পথ-ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা ব্যবস্থার অনুসরণ স্বাভাবিকভাবেই ভাগ্যের দয়াময় আল্লাহতাআলার সূত্র মতেই ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
অতএব বোঝা যায়, দয়াময় আল্লাহতাআলার নির্ধারিত নিয়মেই মানুষের সৌভাগ্যের যেমন কিছু কারণ ও তা লাভের নিয়ম, পদ্ধতি এবং স্তর রয়েছে। এ কারণ প্রক্রিয়া ও সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার ভূমিকাও অতীব স্পষ্ট। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, মানবতা-জুলুম, স্বাধীনতা-পরাধীনতার চিরন্তন দ্বন্ধের আবহমান ইতিহাসের সাথে এই দুই স্তরের সাথে ব্যক্তিজীবনে এবং সামাজিক জীবনে ভাগ্যের উত্থান-পতন কিংবা পাওয়া না পাওয়ার ঘটনাবলীই মানুষের জীবনের ইতিহাস।
ব্যক্তি জীবনে যথাযথ দায়িত্ব জ্ঞান ও সমাজ জীবনে সুবিচার, অধিকার অর্জন ও প্রতিষ্ঠার জন্য এবং জুলুম-শোষণ-দুর্ভোগ দূর করার জন্য ব্যক্তিক, সামষ্টিক ও সামাজিক প্রচেষ্টা ভাগ্য নির্ধারণে অপরিহার্য শর্ত। এ প্রচেষ্টাও এক প্রকার নির্দেশিত পদ্ধতি ও অছিলা যার মাধ্যমে দয়াময় আল্লাহতাআলা ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামের রহমত অর্জিত হয়ে সবার জীবনে আলো, শান্তি সাফল্যের দ্বার উম্মোচিত হয়। প্রত্যেক প্রচেষ্টা তার শক্তির অনুপাতে এবং সঠিক বা ভূল অনূসৃত দিকের ভিত্তিতে পরিণতি বয়ে আনবে, এটাও প্রাকৃতিক বিধান। আর প্রচেষ্টার অন্তর্নিহিত মেধা, কৌশল, শক্তি ও উপকরণও মৌলিকভাবে দয়াময় আল্লাহতাআলারই দেয়া, মানুষ তার উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারলেই সে তার প্রচেষ্টার সুফল লাভ করে।
প্রচেষ্টার মধ্যে দয়াময় আল্লাহতাআলা প্রদত্ত অন্তর্নিহিত মূল শক্তি অস্বীকার করে কেবল নিজেদের বাহ্যিক প্রক্রিয়াকেই যারা একমাত্র ও মুখ্য শক্তি মনে করে তারা সত্য হারিয়ে নাস্তিক্যবাদের দিকে ধাবিত হয়। আর যারা দয়াময় আল্লাহতাআলা ও তাঁর প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত পথ পন্থা ব্যবস্থা ত্যাগ করে প্রচেষ্টা ও অছিলা বাদ দিয়ে কিংবা অস্বীকার করে সব কিছু সরাসরি দয়াময় আল্লাহতাআলার নামে চালিয়ে দেয় তারাও অজ্ঞতার অনুসারী এবং মূর্খতার পূজারী। বস্তুতঃ অছিলা অবলম্বন করেই দয়াময় আল্লাহতাআলার প্রতি নির্ভরতাসহকারে সাহায্য কামনা করতে হয় এবং নির্দেশিত পথ পন্থায় এগিয়ে যেতে হয়, আর এ প্রচেষ্টাও যদি হয় বিকৃত পথে, ভুল নেতৃত্বে তাও দুঃখ-দুর্যোগ-ব্যর্থতা নিয়ে আসবে।
দয়াময় আল্লাহতাআলা দুনিয়ায় মানুষকে ভালমন্দ বুঝার, হওয়ার ও করার জ্ঞান-সুযোগ-শক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং প্রতিফলও জানিয়েছেন। অনেকে জীবন ও দুনিয়ার ভালমন্দ উত্থান পতন সবকিছু সরাসরি আল্লাহতাআলার নামে বরাতের উপর চালিয়ে দিতে চায়, যা সত্য নয়। বিশ্ব প্রকৃতি ও সৃষ্টির সবকিছু আল্লাহতাআলার নির্ধারিত প্রাকৃতিক নিয়ম ও বিধানের ভিত্তিতে চলে, সরাসরি হুকুমে নয়, প্রাকৃতিক নিয়ম ও বিধানের মধ্যেই হুকুম দেয়া আছে, বস্তু ও প্রকৃতি দয়াময় আল্লাহতাআলা সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্যে তাঁর বিধান, জ্ঞান, আদেশ, পদ্ধতি, গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে দিয়েছেন যার ব্যতিক্রম হয় না। অনু পরমানু জীবকোষ থেকে উত্থান পতন জীবন মৃত্যু পুনরুত্থান আখেরাত সবকিছুই সে বিধান মোতাবেক চলছে এবং চলবে।
কেবলমাত্র নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামদের মোজেজা ও আওলিয়া কেরামের কারামত এবং মকবুল দোয়ার মাধ্যমে অতি প্রাকৃতিক বা সাধারণ বস্তুগত নিয়ম পদ্ধতির ঊর্ধ্বে দয়াময় আল্লাহতাআলার বিশেষ রহমত ও ক্ষমতার প্রকাশ সংগঠিত হয়। দয়াময় আল্লাহতাআলার নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিধানের বিপরীতে সরাসরি দয়াময় আল্লাহতাআলার হুকুমেই সবকিছু সংগঠিত হলে দুনিয়ায় কখনও মিথ্যা জুলুমের ধারকরা বিজয়ী ক্ষমতাসীন হয়ে সত্য ও মানবতাকে বিধ্বংস করতে পারতো না। বরং এসব বিষয় সত্য ও মানবতার ধারক আর মিথ্যা ও জুলুমের ধারকদের কাজ ও শক্তি অর্জনের উপরই অছিলা হিসেবে নির্ভর করে এবং এটাই দুনিয়ায় দয়াময় আল্লাহতাআলার প্রাকৃতিক বিধান। মিথ্যা ও জুলুম শোষণ পরাধীনতা অবমাননা থেকে মুক্ত হতে হলে সত্য ও মানবতার শক্তিকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে যেমন করেছেন মহান মকবুল সাহাবায়ে কেরাম ও মহান আওলিয়া কেরাম।
অনেকে দয়াময় আল্লাহতাআলার নির্ধারিত বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মনীতি উপলদ্ধি করতে না পেরে এ সব বিষয়ে অবাস্তব বিকৃত ধারণা পোষণ করে, কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করতেও দ্বিধা করেনা। যেমন-“অন্যায় পথ-পন্থায় জুলুম করে, অন্যের হক লুন্ঠন করে, ধোকা প্রতারণা করে অবৈধভাবে কেউ সম্পদ কুক্ষিগত করলো; কিছুলোকের পাশবিক সমাজ ব্যবস্থায় অনেক লোক বঞ্চিত-নিপীড়িত হলো”- এই যে অবৈধ প্রাচুর্য কিংবা দুর্ভোগ এর কোনোটাই লাইলাতুল বরাতে আল্লাহতাআলার নির্ধারিত দান বা শাস্তি নয়। পরিবেশ দুষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের কারণে দুর্যোগ তৈরি হয়, আবার পৃথিবীর একেক অঞ্চলে একেক মৌসুমে ঘূর্ণিঝড়, প্লাবন ইত্যাদি একটা নির্দিষ্ট ঋতু বা সময়ে হয় এবং এটা প্রায়ই পূর্ব থেকে জানা থাকে। এতে বিশেষতঃ বঞ্চিত জনসাধারণই বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। এ সব কিছু আল্লাহতাআলার নামে চালিয়ে নিজেদের দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থা ঢাকার অপচেষ্টা হীন মিথ্যাচার মাত্র। দয়াময় আল্লাহতাআলা আজাবদাতা গজবদাতা নন বরং তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রহমতে আজাব গজব থেকে উদ্ধারকারী।
দুনিয়া একক গোষ্ঠীবাদি স্বৈররাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে সত্যবিরোধী জীবন বিরোধী বাতিল জালিম অপশক্তির মুলুকিয়তের গ্রাসে চলে যাওয়ায় অপশক্তির বিভিন্ন বিষাক্ত অনাচারের প্রতিক্রিয়ায় জল-স্থল-আকাশ-পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে গেছে। আল্লাহতাআলা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রহমতে জীবনের জন্য যে শান্তিময় কল্যাণকর নিরাপদ পরিবেশ দান তা ধ্বংস হয়ে মারাত্মক বিষাক্ত পরিবেশের কারণে জীবন বিনাশী বিভিন্ন অবস্থা ও ভাইরাস ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে, যার জন্য মানবতা বিরোধী অমানুষরাই দায়ী। এই অমানুষগুলো বিভিন্ন অধর্ম ও বিভিন্ন অনাচার এবং রাষ্ট্রশক্তির বলে প্রকৃত ধ্বংসাত্মক বিভিন্ন কুকর্মের মাধ্যমে শান্তির দুনিয়াকে বিষাক্ত করে তুলেছে। বিষাক্ত অন্যায় অপরাধের এসব বিষাক্ত প্রতিফল আল্লাহতাআলা প্রদত্ত নয় বরং কুকর্মের কুপ্রতিক্রিয়া যার জন্য অমানুষ ও অমানুষের পাশবিক রাষ্ট্রশক্তিই দায়ী, আর এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় সর্বকল্যাণের উৎস প্রাণাধিক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রদত্ত মানবিক মানুষ ও মানবতার দুনিয়া খেলাফতে ইনসানিয়াত।
অবশ্যই আল্লাহতাআলা সর্বজ্ঞান ও সর্বশক্তির মালিক এবং তিনি যে কোন অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন, যা ইচ্ছে দিতে পারেন এবং করতেও পারেন। যেকোনো বিপদ দূর করতে পারেন কিংবা পরীক্ষা বা শাস্তিস্বরূপ দিতেও পারেন। আর সে জন্য আমাদের তাঁর প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর রহমতের কেন্দ্র রাহমাতাল্লিল আলামিনের অছিলা নিয়ে চাইতে হবে তাঁর কাছে এবং পাওয়ার জন্য অবশ্যই চলতে হবে তাঁরই অনুগৃহীত ও তাঁর প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মনোনীত মহামহিম প্রাণপ্রিয় পবিত্র আহলে বায়েত, মহামান্য খোলাফায়ে রাশেদিন, সত্যের ইমামবৃন্দ, মহান আওলিয়ায়ে কেরাম ও মুমিনদের প্রদর্শিত পন্থার অনুসরণে, যুগের সঠিক দিক নির্দেশনায়।
বরাতের উপলক্ষ সাধারণ বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে এক অতীব রহস্যময় নিগুড় তাৎপর্য্যময় বিষয়, কোরআনুল করীম ও হাদিস শরীফে বরকতময় রহমতময় এবং আদেশ নির্ধারণী হিসেবে যার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে (ফিহা ইউফরাকু কুল্লু আমরিন হাকীম, সূরা: দোখান আয়াত: ৪), যার পুর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত হাকিকত কেবল দয়াময় আল্লাহতাআলা ও তাঁর মহান প্রিয়তম হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম এবং তাঁদের মনোনীত বিশিষ্টজনদের যাঁদের তাঁরা জানিয়েছেন তাঁরাই জানেন।
স্বয়ং মহান প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম এ রজনীতে জান্নাতুল বাকী শরীফে (সৌদী গোত্রবাদী ওহাবীবাদী এ স্বৈর সরকার কর্তৃক ধ্বংসকৃত) মহান মকবুল সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুমের পবিত্র মাজার শরীফসমূহ জিয়ারত করেছেন এবং এ রজনীতে বিশেষ দোয়া ও এবাদতের তাকিদ দিয়েছেন- হাদিস শরীফ। বরাতের পবিত্র রজনীতে মানুষের জন্য তার অবস্থা ও কাজের পার্থিব প্রতিফলন নির্ধারিত হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে মাগফেরাত ও তওবার সুযোগ দেওয়া হয়। বিশেষ রহমতের সুযোগ দেওয়া হয় এবং বিশেষভাবে মোনাজাত কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আজ জাতিগতভাবে আমরা মুসলমানরা বিশ্বব্যাপী ভাগ্যবিড়ম্বিত। সবচেয়ে ভাগ্যবান হয়েও তা হারিয়ে চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে নিপতিত। দেশে দেশে হত্যা, উৎখাত, নির্যাতনের অসহায় শিকার, এমনকি আকিদা-বিশ্বাস-সত্তা পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সত্য ও সাফল্যের দ্বীনকে, বিশ্বমানবতার মুক্তির দ্বীনকে বিকৃত ও গন্ডীবদ্ধ করে নিজেদের এবং সমগ্র মানবতার দুর্ভাগ্য ডেকে আনা হচ্ছে।
দ্বীনের নামে বেদ্বীন কাফের এজিদের উত্তরসূরিদের তান্ডব চলছে। এ অবস্থা উত্তরণের জন্য নিজেদের অভ্যন্তরীণ-বাহ্যিক সকল প্রতারক ও শত্রুর কবল থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক পথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে সাফল্যের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েই আল্লাহতাআলার নিকট এ মহান রজনীতে চাইতে হবে রহমত ও সাহায্য, সকল দুর্দশা ও দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি এবং জীবনের স্থায়ী ও অস্থায়ী সকল সৌভাগ্য।
দয়াময় আল্লাহতাআলার সম্পর্ক ও সকল রহমতের মূলকেন্দ্র প্রাণাধিক প্রিয়নবী সাল্লাাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রেম ও শাণে উৎসর্গীকৃত হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহতাআলার হয়ে যাওয়াই জীবনের আসল বরাত বা মূল সৌভাগ্য, জীবনের অন্য সকল রহমত ও বরাত লাভের নির্ধারিত উপায় পবিত্র কলেমা প্রদত্ত জীবনের আত্মমালিকানা ও দুনিয়ার মালিকানা খেলাফতে ইনসানিয়াত (politics for authority of life and state and world of universal humanity; given by beloved holy Rasul, the source of all blessing-love-humanity), সকল রহমত ও বরাত থেকে বঞ্চিত করে দোজাহানে ধ্বংসের উৎস মিথ্যা ও মূর্খতার আঁধার কুফরিয়াত ও জুলুম-বঞ্চনা-রুদ্ধতা- স্বৈরদস্যুতার কারাগার মুলুকিয়ত, ঈমানিয়াত ও ইনসানিয়াতের বিপ্লব ই দোজাহানে জীবনের রুদ্ধ বরাতের মুক্তদ্বার।
আর এভাবেই আসতে পারে বিশ্বব্যাপী সকল মানুষের জন্য দোজাহানের সৌভাগ্য, দূর হতে পারে সকল দুর্ভাগ্য।