মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র, বরকতময়, সংযম ও ধৈর্যের বার্তাবাহী মাস রমজান। আত্মশুদ্ধি, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্মগঠনের মাস রমজান ঘনিয়ে। প্রতি বছর রমজান আসে ঈমানদার মুসলমানদের জীবনকে পরিশুদ্ধ এবং পাপমুক্ত করার জন্য। মুসলিম উম্মাহের কাছে অপেক্ষার প্রহর ঘনিয়ে দুয়ারে কড়া নাড়ছে রমজান। এ মাস যত ঘনিয়ে আসতো, তেমনি ব্যাকুল এবং পুরোদমে প্রস্তুত হয়ে উঠতেন রাসূল (সা.)। এ প্রস্তুতি ছিল শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক। রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। এ মাসে সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বারতা নিয়ে আসে রমজান। কোরআন নাজিলের কারণে রমজান হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মর্যাদাবান। তাই প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। মানবজাতির কল্যাণ লাভ সহ এ মাসে আল্লাহর অফুরন্ত রহমত ও শান্তির বারিধারা বর্ষীত হয়। তাঁর নেয়ামতের ভান্ডার খুলে অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। মুক্তির বার্তা পৌঁছান মুমিনের দুয়ারে দুয়ারে। মহিমান্বিত এ মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে বিধায় এই মাসকে স্বাগত জানিয়ে বরণ করতে হবে। রমজানের আগে অন্তরকে পবিত্র, নিষ্কলুষ, মনকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন অধ্যাবসায় তৈরি করতে হবে।
দীর্ঘ এগার মাসে অন্তরে সৃষ্ট বিষাক্ত মরীচিকা দূর করতেই রমজানের সিয়াম সাধনা। সিয়াম সাধনা মানুষকে ফেরেশতাদের অনুকরণের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব নিজকে প্রবৃত্তির গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার শিক্ষা দেয়। সিয়ামের উদ্দেশ্য মানুষের পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক চাহিদার মধ্যে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখা। সিয়াম দ্বারা মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে সফলতার স্বর্ণশিখরে আরোহন করে। রাসূল (সা.) শিখিয়েছেন কীভাবে রমজানকে গ্রহণ করতে হয়। রমজানের রহমত বরকতে সিক্ত করতে হলে প্রস্তুতি নিতে হবে শাবান মাস থেকেই। রাসূল (সা.) শাবান মাসে নিজেকে পূর্ণভাবে ইবাদাতে মশগুল রেখে সাহাবাদেরকেও আদেশ করতেন ইবাদতে কাটানোর। রজবের শুরু থেকেই পূর্বসূরিরা দোয়া করতেন- আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। তাঁরা সর্বদা দোয়া করতেন, আল্লাহ যেন তাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আরও দোয়া করতেন, রমজানের আমলগুলো আল্লাহ যেন কবুল করেন। রোজার মাধ্যমে মুমিনজীবনের অনন্য প্রাপ্তিসহ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের বহুমুখী কল্যাণের সন্ধান দেন। রমজানে মানুষের গতিপথ বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন কৌশলে অভিশপ্ত শয়তান পাঁয়তারা করতে থাকে। তাই আমাদেরও উচিৎ নিজ দেহ-মনকে প্রস্তুত করা। কিন্তু আমাদের জানা রমজানের চাঁদ উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানব জাতির চিরশত্রু শয়তানকে বন্দী করে দেয়া হয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ থাকে না। রমজানে জান্নাতের দুয়ার খুলা আর জাহান্নামের দুয়ার বন্ধ করা হয়। যারা জীবনের গ্রোতধারা সঠিক পথে প্রবাহিত করতে চান তাদের জন্য রমজান আশির্বাদস্বরূপ।
পার্থিব লোভ-লালসামুক্ত, ত্যাগ-সহিষ্ণুতার সাধনা এবং মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার প্রশিক্ষণে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। দুয়ারে যেহেতু মহিমান্বিত মাসের শুভাগমন তাই সব ধরনের গুনাহ থেকে অবশ্যই তওবা করতে হবে। পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয়ে ইবাদতে নিজেকে মশগুল রাখতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে- ‘হে মুমিনরা! আল্লাহ তায়ালার নিকট তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’ (সূরা: নুর, আয়াত-৩১)। চারদিকে প্রস্তুতি অপেক্ষা রমজান আগমন। রমজানে প্রতিটি মুহূর্তে অনেক বরকত লুকিয়ে আছে, যা নফল কাজগুলো ফরজের মর্যাদা পায়, আর ফরজ কাজগুলো সত্তর গুণ অধিক মর্যাদা পায় (বায়হাকি)। রমজান এলে সৎ পথে চলা সহজ, আর অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে রোজা ঢালস্বরূপ। রমজানের রোজা রাখার ক্ষেত্রে ব্যক্তির অতীত ও বর্তমান সব গোনাহ ক্ষমা করা হয় হাদিসে উল্লেখ আছে। এ মাসে প্রতি রাতে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করতে থাকেন- ‘হে সৎ পথের দিশারি! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের পথিক! সতর্ক হও। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- রমজানের রোজা আল্লাহর কাছে এই বলে সুপারিশ করবে- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার বান্দাকে দিনের বেলা ভোগ-সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি। তাই আজ আমি তার জন্য সুপারিশ করছি’। অথচ, বর্তমান সময়ে সিয়াম সম্পর্কে বহু মুসলমানের ধ্যান ধারণা শৌখিনতায় রূপান্তরিত। তারা এ মাসকে খাবার-দাবার, পান-পানীয়, মিষ্টি-মিষ্টান্ন, রাত জাগা ও স্যাটেলাইট চ্যানেল উপভোগ করার মৌসুম বানিয়ে ফেলেছে। তারা আগে থেকেই এ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন; এই আশংকায়- কিছু খাদ্যদ্রব্য কেনা বাদ পড়ে যেতে পারে অথবা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। এভাবে খাদ্যদ্রব্য কেনা, হরেক রকম পানীয় প্রস্তুত করা এবং কী অনুষ্ঠান দেখবে, আর কী দেখবে না সেটা জানার জন্য স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর প্রোগ্রামসূচী অনুসন্ধান করার প্রস্তুতি নেয়। তারা এ মাসে ইবাদত ও তাকওয়ার পরিবর্তে উদরপূর্তি ও চক্ষুবিলাসের মৌসুমে পরিণত করে। অথচ রমজানের তাৎপর্য সম্পর্কে সত্যিকার অর্থেই তারা অজ্ঞ।
পাপাচারে যাদের জীবন অতিষ্ঠ সিয়াম তাদের ক্ষান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। আর মুমিনের জন্য কাক্সিক্ষত সফলতা হাতছানি দিতে থাকে। পাপের খনিতে নিমজ্জিত বান্দাকেও এ মাসের বরকতে ক্ষমার অঙ্গীকার করেছেন আল্লাহ। রমজানের প্রাপ্তি ও সুফল নিশ্চিত হওয়ার পূর্বশর্ত হলো, এ মাসের মর্যাদা যথাযথভাবে আদায় করা। তবে রমজান উপলক্ষে সর্বপ্রথম মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। রমজানে পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা অতি সহজ। আমাদের একটু সদিচ্ছাই পারে পাপমুক্ত জীবন সূচনা করতে। এই মাসে সহিহ-শুদ্ধরূপে কোরআন বেশি বেশি তেলাওয়াত করার প্রিপারেশন নিতে হবে এবং কোরআনের পেছনে প্রচুর সময় দিতে হবে। তিলাওয়াতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। ফেসবুক, ইউটিউব ও অনৈসলামিক টিভি প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে সময় নষ্ট না করার দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিপর্যায় থেকে পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গণসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।
রমজান মাস মুসলমানের জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। এই মাসের আগমন কল্যাণ ও রহমতের। ইরশাদ হচ্ছে- ‘বলুন, এটি আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। এটি তারা যা সঞ্চয় করে রাখে তা থেকে উত্তম’ (সূরা: ইঊনুস, আয়াত-৫৮)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘হে লোক সকল, তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর, আমি তাঁর নিকট দৈনিক একশত বার তওবা করি’ (মুসলিম)। অনৈতিক কোনো অভ্যাস থাকলে তা ছেড়ে দেওয়ার সংকল্প করতে হবে। কেননা রমজান তো ভালো মানুষ হবার ট্রেনিং কোর্স। কর্মব্যস্ততাও কিভাবে বেশি ইবাদত করা যায়, তার পরিকল্পনা করা উচিত। কাজের ফাঁকে ও অফিসে যেতে-আসতে কিভাবে ইবাদতে কাটানো যায় তার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। রমজানে ইবাদতের পরিবেশ তৈরি এবং পবিত্রতা রক্ষায় সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য। কারণ প্রতিটি নেক আমলের বিনিময় ন্যূনতম দশগুণ বৃদ্ধি করা হয়। মুসলমানদের ক্ষমার জন্য বিশেষ পরিবেশ তৈরি করা হয়। রমজান মাস ইবাদত, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, ঈমান নবায়ন এবং গুনাহ মাফের মাস। যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারল না রাসূল (সা.) তাকে ধিক্কার জানিয়েছেন। তাই এই মহিমান্বিত মাসটি কীভাবে কাটাবেন, আগে থেকেই প্রস্তুতি নিন। আল্লাহ আমাদের তাঁর সান্নিধ্য লাভের পাশাপাশি রহমত, মাগফিরাত ও ক্ষমা প্রাপ্তির বিশেষ তওফিক দান করুন। আমিন।