কাজিরবাজার ডেস্ক :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল সেটি বড় যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও তারপরও ছোট ছোট ৫০টির মতো যুদ্ধ হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক আর্থিক সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ‘সিস্টেম’ ঠিকমতো কাজ করেছিল। কোভিড মহামারি, নতুন শক্তির উত্থান এবং বর্তমানে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ব্যবস্থাটিকে ভেঙে দিয়েছে। দুটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার বলয় রক্ষা করা নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং নতুন শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান গোটা ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করছে। এর ফলশ্রুতিতে নতুন ব্যবস্থার দিকে হাঁটছে বিশ্ব; যা গোটা ক্ষমতা বলয়ের মেরুকরণে পরিবর্তন আনতে পারে।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, প্রথমত দুটি ক্ষয়িষ্ণু শক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের ক্ষমতার বলয় রক্ষা করার যুদ্ধ শুরু করেছে। আবার অন্যদিকে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে চীন। এছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী শক্তি হিসেবে ভারত ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে চায়; যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান।
ক্ষমতার বিভিন্নমুখী প্রকাশ আছে যেমন সামরিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অর্থনৈতিক শক্তি, অর্থাৎ কার কাছে কত সম্পদ আছে এবং কে টিকে থাকবে। তৃতীয় যে প্রকাশ সেটি হচ্ছে আদর্শের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর সঙ্গে সংস্কৃতি জড়িত বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, বর্তমানে মুক্ত বিশ্ব বনাম কর্তৃত্ববাদের মধ্যে বিরোধটি অত্যন্ত প্রকট। আবার মুক্ত বিশ্বের সমর্থকদের ক্ষমতা এখন ক্ষয়িষ্ণু। কিন্তু উদীয়মান শক্তির দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদের প্রকাশ বেশি, যেমন চীন। এখন পরিস্থিতি অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে গেছে। রাশিয়ার বেপরোয়া আক্রমণের ফলে গোটা বিশ্ব এখন একটি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে পড়ে গেছে। ভবিষ্যৎ আগের থেকে অনেক বেশি অনিশ্চিত।
হাইব্রিড যুদ্ধ
অতীতে যুদ্ধের একটি মাত্র প্রকাশ ছিল এবং সেটি হচ্ছে সামরিক শক্তি প্রয়োগ। কিন্তু এখন যুদ্ধের অনেক বহিঃপ্রকাশ আছে। এর যেমন আর্থিক লেনদেনের ওপর প্রভাব আছে, আবার সাপ্লাই চেইনের ওপর প্রভাব আছে। একই সঙ্গে জ্বালানি খাতেও এর প্রভাব আছে। সাইবার নিরাপত্তাও এর সঙ্গে জড়িত। মোটকথা যুদ্ধের আকার, প্রকৃতির মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে গেছে, যা আগে ছিল না।
শহীদুল হক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোকে সুইফট সিস্টেম থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, যা আর্থিক লেনদেনকে সংকুচিত করছে। আবার সাইবার যুদ্ধও চলছে, যেখানে একপক্ষ আরেকপক্ষের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে গোলোযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করছে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশের ওপর প্রভাব
বর্তমান বৈশ্বিক ঘটনা বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কা তৈরি করছে। কারণ, বর্তমান যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে একটি পক্ষ নেওয়ার বিষয় সামনে চলে আসতে পারে। কী করণীয় জানতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, সবচেয়ে সোজা হলো যেকোনও একটি পক্ষে যোগ দেওয়া এবং এই প্রস্তাবটি টেবিলে আছে। বিষয়টি হচ্ছে তিন নৌকায় পা দিয়ে চলবে নাকি এক নৌকায় চলবে।
তিনি বলেন, যে ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশ চলছিল সেটা নতুন করে গড়ে তুলতে হবে এবং সেজন্য যেকোনও ধরনের ক্রাইসিসের সময়ে একটি অবস্থান নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর সুবিধা হচ্ছে অন্যান্য দেশ একটি বার্তা পায় বাংলাদেশের চিন্তাধারা সম্পর্কে।
কোনও অবস্থান না নেওয়া খুব একটা বাস্তবসম্মত বিষয় নয়। যে নীতিই গ্রহণ করা হোক সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, অর্থাৎ রাশিয়ার জন্য একটি অবস্থান আবার যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশের ভিন্ন অবস্থান, সেটি কাম্য নয় বলে তিনি জানান।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, শুধু লেনদেনের কথা বিবেচনা করে আপাতদৃষ্টিতে নিকট ভবিষ্যতে লাভজনক এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। দূরবর্তী ভবিষ্যতে লাভ হবে কিন্তু বর্তমানে কষ্ট হবে, এমন অবস্থান গ্রহণ করা শ্রেয়। কারণ, এর মাধ্যমে দেশের চরিত্রের প্রতিফলন ফুটে ওঠে।
তিনি বলেন, দেশের চরিত্রের ভিত্তি হবে আদর্শভিত্তিক পররাষ্ট্র নীতি এবং এরমধ্যে নমনীয়তা থাকবে, বিচ্যুতি থাকবে, বাস্তববাদ থাকবে কিন্তু মূল্যবোধ এবং নীতি আদর্শের সমন্বয় থাকতে হবে। এর প্রেক্ষাপট হবে জাতীয় স্বার্থ। এর অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণ বাস্তববাদ এবং সম্পূর্ণ আদর্শবাদের মাঝখানে একটি অবস্থান নিতে হবে।
জোট বনাম বন্ধু
আদর্শভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি একা করা যায়, বন্ধুদের সঙ্গে করা যায় আবার জোটবদ্ধভাবে করা যায়। কোনও জোটে না থাকার যেমন একটি অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, আবার কোনও জোটে যোগ দেওয়ারও একটি শক্তি আছে।
শহীদুল হক বলেন, মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ’জোট’ এবং ’বন্ধুত্ব’ এক জিনিস না। যখন জোটে যোগ দেওয়া হয় তখন এক দেশ অপরকে সহায়তা করে। অন্যদিকে বন্ধু হচ্ছে তোমার যুদ্ধ তুমি করবে, আমার যুদ্ধ আমি করবো। একই সঙ্গে সিকিউরিটি প্যাক্ট এবং কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ এক জিনিস না।
প্রতিটি সিদ্ধান্তের একটি লাভজনক দিক এবং ক্ষতিকর দিক আছে। এখন দেখতে হবে কোন রাস্তায় গেলে লাভ বেশি ক্ষতি কম বলে তিনি জানান।