॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণরৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট সুশোভিত করা হয়েছে। এইসব ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহ তাই নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল।”
এখানে ‘ক্বানতীর’ শব্দটি বহুবচন। একবচন ‘ক্বিনতারুন’ যার অর্থ হল- ‘বিশাল এক গুচ্ছ সম্পদ’ আয-যাহহাক বলেছেন, আয়াতে ‘আল কানাতিরুল মুকানতারাতু’ হল স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিশাল সম্পদ ইমাম কাতাদাও অনুরূপ বলেছেন এবং ইমাম তাবারী এটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- “যারা স্বর্ণ এবং রৌপ্য আবদ্ধ বা কুক্ষিগত করে রাখে এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন”। এখানে ‘ইয়াকনিযুনাস যাহারা ওয়ালফিদ্ধাতা এর অর্থ হল- উৎপাদন কিংবা ভোগের জন্য অর্থ ব্যবহার না করে আবদ্ধ করে রাখা। স্বর্ণ এবং রৌপ্য যেহেতু মানুষের নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ। কাজেই তা বর্ণনায় এসেছে। আল্লাহ তাআলা নেককার মুমিনদের সম্পর্কে বলেন, জান্নাতের মধ্যে তাদেরকে পরানো হবে স্বর্ণের অলংকারসমূহ।
কুরআন মাজীদে ‘আল ফিদদাতু’ বা রৌপ্যের পরিবর্তে কখনো ‘আল ওয়ারকু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন- আল্লাহ তাআলা আহলে কাহাফের বর্ণনায় বলেন- ‘এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে পাঠাও। সে যেন দেখে কোন খাদ্য ভালো এবং তা থেকে কিছু আহার সামগ্রি তোমাদের জন্য নিয়ে আসে। সে যেন বিচক্ষণতার সাথে কাজ করে কিছুতেই যেন তোমাদের সম্বন্ধে কাউকে কিছু জানতে না দেয়া’। এখানে ‘আল ওয়ারাকু’ বলতে দিরহাম বুঝানো হয়েছে। ভাষাবিদদের নিকট শব্দটি এই অর্থেই প্রসিদ্ধ। তবে কেউ কেউ বলেছেন, এটি রৌপ্য। উক্ত আয়াতটি প্রমাণ করে যে, মুদ্রা বা ‘নুকূদ’ এর ইতিহাস বেশ পুরাতন।
কুরআন মাজীদ অবতীর্ণের সময় মৌলিক দুটি মুদ্রা প্রচলিত ছিল, তাহলো স্বর্ণমুদ্রা ‘দিনার’ এবং রৌপ্য মুদ্রা ‘দিরহাম’ এবং কুরআন মাজীদে এ দু’টি মুদ্রার উল্লেখ রয়েছে। ইহুদিদের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন বলেছে, “আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন লোক আছে যার কাছে তুমি বিপুল পরিমাণ সম্পদ আমানত রাখলেও তোমাকে তা ফেরত দিবে, আবার এমন লোকও আছে যার কাছে তুমি মাত্র এক দিনার পরিমাণ আমানত রাখলেও সে তোমাকে ফেরত দিবেনা তবে যতক্ষণ তুমি তার নিকট উপস্থিত থাকবে”। ইউসুফ আ. কে যারা কুপে পেয়েছিল এবং তাকে মিসরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন বলেছে, “এবং তারা অতি অল্প মূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে তাকে ক্রয় করেছিল”
উপরোক্ত বর্ণনায় দুটি মূল্যবান ধাতব মুদ্রার উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ ‘স্বর্ণ মুদ্রা’ ও ‘রৌপ্য মুদ্রা’। এ দুটি মুদ্রা ছাড়াও কুরআন শরীফে অন্য প্রকারের একটি মুদ্রার কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তাহলো ‘দ্রব্য মুদ্রা’ অর্থাৎ দ্রব্যের বিনিময়ে দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের প্রথা যা তৎকালে প্রচলিত ছিল। সে সময় বিশেষ ধরনের দ্রব্য ‘মুদ্রা’ হিসেবে বিবেচিত হতো, যার বিনিময়ে অন্যান্য দ্রব্যের আদান প্রদান হতো। এ ধরনের ইঙ্গিত সূরা ইউসুফে রয়েছে। কেননা প্রদেশে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল তার বর্ণনায় এসেছে: “ইউসুফ আ.-এর ভাইয়েরা মিসরে এসেছিল তাদের নিকট বিদ্যমান দ্রব্যাদির বিনিময়ে সাহায্য নিতে”। ৩টি আয়াতে বিদ্বায়াতু বা দ্রব্যের বর্ণনা করা হয়েছে- আল্লাহ তাআলা বলেন- “ইউসুফ তার ভাইদের বলল, তারা যে পণ্যমূল্য দিয়েছে তা তাদের মালপত্রের মধ্যে রেখে দাও যাতে স্বজনদের কাছে ফেরার পর তারা তা চিনতে পারে তাহলে তারা পুনরায় আসতে পারবে। যখন তারা তাদের মালপত্র খুললো তখন তারা দেখতে পেল তাদের পণ্যমূল্য তাদেরকেই ফেরত দেয়া হয়েছে। তারা বলল, হে পিতা! আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি আমাদের দেয়া পণ্যমূল্য আমাদেরকে ফেরত দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের পরিবারকে খাদ্য সামগ্রি এনে দেব এবং আমাদের ভাইয়ের রক্ষণাবেক্ষণ করব তা ছাড়া আমরা আরো অতিরিক্ত এক উট বোঝাই করে পণ্য আনব; যা এনেছি তা পরিমাণে খুবই অল্প। যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হলো তখন বলল, হে আযীয! আমরা ও আমাদের পরিবার-পরিজন বিপন্ন হয়ে পড়েছি এবং আমরা খুব অল্প পুঁজি নিয়ে এসেছি আপনি আমাদেরকে পূর্ণমাত্রায় আহার সামগ্রি দিন এবং আমাদের প্রতি দান করুন আল্লাহ দাতাদেরকে পুরস্কৃত করেন।”
এতে কোন ধরনের বিদ্বাআতু বা দ্রব্য ইউসুফ আ.-এর ভাইয়েরা নিয়ে এসেছিল তার বিনিময়ে সাহায্যের জন্য সে ব্যাপারে তাফসীর বিশারদগণদের মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মত হলো তা ‘দিরহাম’ কিংবা ‘দিনার’ অথবা কোনটাই ছিল না বরং তা ছিল এমন এক ধরনের বস্তু যা তাদের যুগে সহজ প্রাপ্য ছিল, যেমন ‘জুতো’ এবং ‘চামড়া’। যেমনটি বলেছেন ইবনে আব্বাস রা.। এ আলোচনায় প্রমাণিত হল যে, ঐ দ্রব্যগুলো দিরহাম কিংবা দিনার ছিল যে, বরং তা ছিল ‘দ্রব্যমূল্য’ জাতীয়। সুতরাং এ আলোচনায় এটাই ইঙ্গিত বহন করে যে, মুদ্রার বিষয়টি নির্ভর করে প্রচলন ও পরিভাষার উপর। সৃষ্টিগতভাবে তা কোন মূল্য নয়, অনেকেই যেমনটি মনে করেন এবং শুধু স্বর্ণ ও রৌপ্যের উপর সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন।
কুরআনের মত হাদীসেও নুকূদ বা মুদ্রার বর্ণনা এসেছে, নবুয়্যতের সময় প্রচলিত বিভিন্ন নামে যেমন, ‘আয্ যাহাবু’ বা স্বর্ণ, ‘আল ফিদ্দাতু’ বা রৌপ্য, দিনার, দিরহাম ইত্যাদি। হাদীসে বর্ণিত আছে, স্বর্ণ মুদ্রা এবং রৌপ্য মুদ্রা, এ দুটি মুদ্রাই কেবল বিনিময় মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হতো। আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) এবং আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ (স.) খায়বরে একজন লোককে যাকাত আদায় করার জন্য প্রেরণ করেন। অতঃপর তিনি সেখান থেকে উন্নতমানের খেজুর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (স.) এর দরবারে হাজির হলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, খায়বরের সব খেজুর কি এ রকম? তিনি উত্তরে বলেন, না; আমরা দুই ‘সা’ নিম্নমানের খেজুরের বিনিময়ে এ রকম উন্নতমানের এক ‘সা’ খেজুর ক্রয় করি এবং তিন ‘সা’ এর বিনিময়ে দুই ‘সা’ খেজুর ক্রয় করি। রাসূলুল্লাহ (স.) এর বলেন, তোমরা এ রকম করো না। প্রথমে নিম্নমানের খেজুর দিরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করো তার পর ‘দিরহাম’ দিয়ে উন্নতমানের খেজুর ক্রয় করো”। এটা হল স্বর্ণ মুদ্রা কিংবা রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে দ্রব্য বিনিময় কিন্তু স্বর্ণ মুদ্রার’ বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে রৌপ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে সমান সমান হতে হবে এবং উভয় পক্ষের হস্তগত হওয়া আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, “স্বর্ণের বিনিময়ে অতিরিক্ত যা হবে তা সুদ, আর এই প্রকারের বস্তুগুলো বিভিন্ন রকমের হলে তোমরা যেমন ইচ্ছা বিক্রি বা বিনিময় করো যদি তা হাতে হাতে বা নগদে হয়। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, দিনারের বিনিময়ে দিনার এবং দিরহামের বিনিময়ে দিরহাম, উভয়ের মধ্যে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা যাবে না।
স্বর্ণ মুদ্রা এবং রৌপ্য মুদ্রা উভয়ই দ্রব্যের মূল্য পরিমাপক, এ দুটির মাধ্যমে যাকাত, দিয়াত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত পরিমাণ নির্ধারিত হয়। অতঃপর যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নবী স. বলেন, ‘পাঁচ আওয়াক’ রূপার চেয়ে কম হলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। আমর ইবনে শুয়াইব পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদা সূত্রে বর্ণনা করেন। তিনি নবী স. হতে বর্ণনা করেন যে, “২০ মিসকাল স্বর্ণের কম এবং ২০০ দিরহাম রৌপ্যের কম পরিমাণের উপর কোন যাকাত নেই।
ভুলক্রমে হত্যার দিয়াতের পরিমাণ দিরহামের ভিত্তিতে নির্ধারণের বেলায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স.) এর আমলে একজন লোক অন্য একজন লোককে খুন করেছিল, অতঃপর নবী (স.) তার দিয়াতের পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন বার হাজার দিরহাম। দিনারের ভিত্তিতে দিয়াতের পরিমাণ নির্ধারণের বেলায়, আমর ইবনে হাজমকে লিখিত চিঠিতে নবী (স.) বলেন, স্বর্ণ মুদ্রায় বিনিময়কারীদের জন্য এক হাজার দিনার। অপরদিকে অনেক হাদীসে বর্ণিত আছে, নবী (স.) তাঁর জীবনে মুদ্রা ব্যবহার করেছেন এবং নিদ্ধিধায় স্বর্ণ ও রৌপ্য বিনিময় হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
প্রমাণ আছে যে, তিনি আসআদ বিন জুরারা থেকে এক খন্ড জমি ক্রয় করেছিলেন যা তার ঘরে প্রতিপালিত দু’জন ইয়াতীমের সম্পদ ছিল। তাদের দু’জনের নাম ছিল ‘সোহেল’ এবং ‘সুহাইল’। তাদের পিতা বনাম ছিল রাফে। তিনি তা তার নিকট থেকে দশ দিনারের বিনিময়ে ক্রয় করেছিলেন। আবু বকর (রা.) এ অর্থ পরিশোধ করেছিলেন। তারিখ আল-তাবারিতে আছে, নবী (স.) যে প্রথম ঘোড়াটির মালিক হয়েছিলেন সেটা তিনি মদীনায় বনি ফুজারার কোন এক ব্যক্তি থেকে দশ স্বর্ণ মুদ্রা বা আওয়াক দিয়ে ক্রয় করেছিলেন। আলী (রা.) বলেন, নবী (স.) আমার সাথে ফাতিমাকে বিবাহ দিয়েছেন চারশত আশি দিরহাম মোহরানায়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, নবী (স.) যে মুদ্রা ব্যবহার করেছেন তা স্বর্ণের দিনার কিংবা রৌপ্যের দিরহামই হোক না কেন দু’টি মুদ্রাই অমুসলিম দেশ থেকে আসতো, এতে একদিকে ইসলাম ধর্মের উদারতা প্রমাণিত হয়।
উপরোক্ত আলোচনা হতে জানা গেল, আধুনিক জগতের সকল দ্রব্য বস্তু ও সম্পদের মূল্য পরিমাপক এবং বিনিময় মাধ্যম হিসেবে এবং সকল অর্থনৈতিক কারবারের চাবিকাঠি হিসেবে মুদ্রা অপরিহার্য মাধ্যম। আধুনিক মুদ্রার উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসে ইসলামের গৌরবোজ্জল ভূমিকা রয়েছে, যদিও আধুনিক অর্থনীতির প্রবক্তাগণ ইসলামের এই অবদানকে উপেক্ষা করতে চান। ইসলামের আবির্ভাবের যুগসন্ধিক্ষণে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের ‘দিনার’ ও ‘দিরহাম’ আরব বিশ্বেও ব্যবহার হতো। ইসলামের আবির্ভাবের পর নব গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মহান খলীফা উমর (রা.) এর আমল থেকে ইসলামী মুদ্রার উৎপত্তি ও বিকাশ শুরু হয়ে বাগদানের পতন পর্যন্ত ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে একটি অতি উন্নত এবং পূর্ণাঙ্গ ইসলামী মুদ্রা ও মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছিল। ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত স্বর্ণ মুদ্রা ‘দিনার’ এবং রৌপ্য মুদ্রার ‘দিরহাম’ তৎকালীন প্রায় গোটা পৃথিবীতে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে গণ্য হতো। ইসলামী শাসনামলের অবসানের পরও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ইসলামী মুদ্রা বিভিন্ন নামে ব্যবহৃত হতো। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন যাদুঘরে ‘ইসলামী মুদ্রা’ সংরক্ষিত আছে। তাই মুদ্রার ইতিহাস তথা আধুনিক মুদ্রার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ইসলাম ও ‘ইসলামী মুদ্রা’ ও মুদ্রা ব্যবস্থার গুরুত্ব ও অবদান অবিস্মরণীয়। ইসলামী শাসনামলের অবসানের পর বহু শতাব্দি কাল গোটা পৃথিবী ইসলামের আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। তারপর প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মুসলিম দেশগুলো পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে। মুসলমানরা হারানো গৌরব আবার ফিরে পায়। দিকে দিকে শুরু হয় মুসলমানদের নব জাগরণ। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ইসলামী অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে নানা গবেষণা চলছে। ইসলামী মুদ্রাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তাই এখন সময়ের দাবি। (সমাপ্ত)