কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা মহামারীর কারণে গত দুই বছরে দেশের শিল্প খাত সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। শিল্প স্থাপনে ব্যবহৃত মূলধনী যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি তলানিতে পৌঁছে। এতে মারাত্মক ব্যাহত হয় শিল্পোৎপাদন। বিরূপ প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে। সেই আঁধার কেটে জেগে উঠছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধানতম চালিকাশক্তি ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনমুখী শিল্প খাত। একই সঙ্গে বেসরকারী খাতে ঋণের জোগান বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.০৭ শতাংশ বেড়েছে। সে হিসাবে জানুয়ারিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি গত ২৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদ ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলেছেন, আশার কথা হচ্ছে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ (মূলধনী যন্ত্রাংশ) ও কাঁচামাল আমদানি বাড়ছে। এটি কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগবান্ধব লক্ষণ। স্বস্তির জায়গা হচ্ছে বেসরকারী খাতে ঋণের জোগানও বেড়েছে।
করোনার প্রকোপ কমার পর দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার হিড়িক পড়েছে। প্রতি মাসে রেকর্ড হচ্ছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে ৮৬৫ কোটি (৮.৬৫ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা) টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৭৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এত বিপুল অঙ্কের বিদেশী মুদ্রা খরচ হতে দেখা যায়নি। এর আগে সর্বোচ্চ এলসি খোলার পরিমাণ ছিল নবেম্বর মাসে ৮১০ কোটি ৭০ লাখ (৮.১০ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের মাস অক্টোবরে ৭৪২ কোটি ১৬ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন (৪ হাজার ৪০৭ কোটি ৫৪ লাখ) ডলারের এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৬৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ২৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই ছয় মাসে দেশে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করায় সে সব দেশের মানুষ আগের মতো পণ্য কেনা শুরু করেছেন। দেশের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যাপক বেড়ে গেছে। দুই বছরের মহামারীর পর আগামী দিনগুলোতে সেই চাহিদা আরও বাড়বে। সে চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নতুন উদ্যমে উৎপাদন কর্মকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সে কারণেই শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ (ক্যাপিটাল মেশিনারি) সব ধরনের পণ্য আমদানিই বেড়ে গেছে। বেড়েছে এলসি খোলার পরিমাণ।
এদিকে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের আতঙ্কও কেটে গেছে। বাংলাদেশসহ সব দেশের অর্থনীতিই করোনার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। সবমিলিয়ে আমদানিতে জোয়ার দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ অন্য সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এলসি খুলতে বেশি অর্থ খরচ হয়েছে বলে জানান তারা। করোনা মহামারীর মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ৭০৪ কোটি (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলেছিলেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। ওই অঙ্ক ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের মধ্যে শিল্পোৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত বছর যে এলসি খুলতে লেগেছিল ১০০ টাকা, এখন তা খুলতে লাগছে ১৩০ টাকা। এ কারণে ব্যাংক খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ওই সব দেশ থেকে কিছু বিনিয়োগ বাংলাদেশে আসছে। ফলে বাংলাদেশী কিছু উদ্যোক্তা নতুন ইউনিট সম্প্রসারণের দিকে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে আশা করেছিলাম বিনিয়োগ বাড়বে, ওই ভাবে গতি দেখা যাচ্ছে না। করোনায় যেসব সমস্যায় আমরা পড়েছিলাম, তা থেকে পুরোপুরি বের হতে পারিনি এখনও। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ওমিক্রন নিয়ে ভয়ের কোন কারণ আপাতত নেই। ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রচুর অর্ডার আসছে।’
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মোঃ আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রভাবে মন্দাভাব আসা ব্যবসা-বাণিজ্য এখন চাঙ্গা হয়েছে। শিল্প কারখানা পুরোপুরি সচল। ফলে কারখানার কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিও অনেক বেড়েছে। এটা ভাল। তবে যে হারে আমদানি হয়েছে সেভাবে রফতানি বাড়েনি। রফতানি আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। তিনি বলেন, আমদানি বেড়েছে এটা ভাল। এর মানে বিনিয়োগ হচ্ছে, নতুন কর্মসংস্থান হবে। নতুন নতুন ক্রয়াদেশ আসছে, রফতানি বাড়বে। তবে আমদানির আড়ালে যেন অর্থ পাচার না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে কোভিডের তীব্রতা কমার পর আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির ফলে বেসরকারী খাতের ঋণের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। টানা সাত মাস বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের জানুয়ারিতেও অব্যাহত ছিল। প্রায় আড়াই বছরের মধ্যে জানুয়ারির ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৩২ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারী ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৬৬ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪০ হাজার ২৩ কোটি টাকা। এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) নতুন চেয়ারম্যান ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘যদিও জানুয়ারিতে দীর্ঘদিন পরে এত বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা থেকে তা অনেকটা কম।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটলেও আবার নতুন করে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ায় এর কী প্রভাব পড়বে সেটা বোঝা কঠিন। আমি মনে করি চলতি বছর খুবই কঠিন যাবে। আমরা যতটা পারি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের ওপর বাহ্যিক প্রভাব পড়ছে। তেলের দাম বাড়ছে, গমের দাম বাড়ছে, ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে বহু দেশই শঙ্কিত। তবে প্রভাব এখনই বোঝা যাবে কিনা নিশ্চিত নয়। চার-ছয়মাস পরেও তা দৃশ্যমান হতে পারে।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভাল দিক। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে। তার মানে নতুন বছর বিনিয়োগের একটি ইতিবাচক আবহ নিয়েই শুরু হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এর ফলে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। তবে এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে।’
চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছরের জুলাই মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল। সেখানে বেসরকারী খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে ডিসেম্বর শেষে উদ্যোক্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে এখনও প্রায় ৪ শতাংশ ঋণ কম নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোভিডের কারণে গত মে মাসে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি খুবই কম ছিল। সে সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে আসে। এর পর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ে। ২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে তা নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটে। তারপর থেকে ঋণ প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।