কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের তাপ স্পর্শ করতে পারে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মাইল দূরের বাংলাদেশকে। বিশ্ববাজারে গম রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে উপরের দিকে রয়েছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাম। আর ইউরোপে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহের মূল উৎসস্থল হচ্ছে রাশিয়া। ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সেঞ্চুরি পেরিয়েছে। এতে দেশের শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে একমত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলো। প্রথম ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ যে দুটি রাশিয়ান ব্যাংকের ওপর অবরোধ দিয়েছে তার একটি সে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ভিইবি। যেখান থেকে আসছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়ন। সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ বা সোয়া ১১ বিলিয়ন ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু সেখান থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এসেছে মাত্র ৪ বিলিয়ন। বাকি অর্থ চলমান থাকবে কি-না বা কবে আসবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যুদ্ধের প্রভাব পড়বে না এ প্রকল্পে। এছাড়া চলমান রফতানি আদেশ এবং ভবিষ্যতের ক্রয়াদেশ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগে পড়ার কথা বলেছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক। ইতোমধ্যে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের জেরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের অংশ হিসেবে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে রাজি হওয়ার কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফট হলো দ্রুত ও নিরাপদে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা। বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুইফট যুক্ত। রাশিয়া তার তেল ও গ্যাস রফতানির জন্য সুইফট সিস্টেমের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর বাদ দেয়ার পদক্ষেপের প্রভাব দেশটির ব্যাংকিং নেটওয়ার্কে পড়বে। কারণ, এই ব্যবস্থার আওতায় লেনদেন করা রুশ ব্যাংকগুলো বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে। ফলে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতীতে শুধু একটি দেশকেই সুইফট থেকে বাদ দেয়া হয়। সে দেশটি হলো ইরান। এর ফলে ইরানকে তার বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ হারাতে হয়। সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার প্রভাব শুধু রাশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না। ক্ষতির মুখে পড়বে অন্য দেশও। রাশিয়া থেকে তেল বা গ্যাস ক্রেতা দেশগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান তেল ও জ্বালানি সরবরাহকারী রাশিয়া। এদিকে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়গুলো প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে বলেছে, রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে কোন সঙ্কট সৃষ্টি হবে না। দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য চলবে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট এ্যাটমিক এনার্জি কর্র্পোরেশন নির্মাণ করছে। সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশ বা সোয়া ১১ বিলিয়ন ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া। ২০২১ সাল পর্যন্ত এসেছে মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলার। বাকি অর্থ আদৌ আসবে কিনা বা কবে আসবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও সম্প্রতি গণমাধ্যমে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ রাশিয়ার সঙ্গে যেসব উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য রয়েছে, তা চলমান থাকবে। আমাদের কাজের অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। সেখানে প্রভাব ফেলবে না। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন হতে পারে, বিজনেস ট্রানজেকশন হতে পারে। সেক্ষেত্রে কিন্তু যারা নিষেধাজ্ঞা ইস্যুকারী দেশ তারা বাংলাদেশকেও শাস্তির আওতায় আনতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের এই ঝুঁকিগুলো এখনই বিশ্লেষণ করে কখন, কোন্দিক থেকে আসতে পারে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রস্তুত করে রাখতে হবে। ভবিষ্যত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আরও দক্ষ ও দূরদর্শী হবার বিকল্প নেই বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশ কোন পার্টি না হলেও এর প্রভাব থেকে কোনভাবেই মুক্ত নয়। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশে গম আমদানিতে খরচ বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে আটার দামের ওপর। ফলে দেশের বাজারে এমনিতেই বাড়তে থাকা খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। সরকারী তথ্য মতে, ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন ছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন, বর্তমানে সেটি কমে ১২-১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে। অপরদিকে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে গমের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতাও বেড়েছে। বর্তমানে দেশে গমের বার্ষিক চাহিদা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির চাহিদার বেশিরভাগই আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। গত অর্থবছরে প্রায় ৭৫ লাখ মেট্রিক টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১২ লাখ টনের কিছু বেশি। এ ছাড়া সরকারী পর্যায়ে আরও প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন আমদানি বাদ দিলে, বাকি ৫৮ লাখ মেট্রিক টনের পুরোটাই আমদানি হয় বেসরকারী খাতের মাধ্যমে। আর বেসরকারী খাতের এই আমদানির বেশিরভাগই আসে রাশিয়া-ইউক্রেন, আর্জেন্টিনা ও ভারত থেকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত আমদানি হচ্ছে তুলা, গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল। দেশে বছরে গমের চাহিদা সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টনের মধ্যে ৩৫ লাখ টন আসছে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। এ গম প্রক্রিয়াজাত করে ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে বেড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাশিয়া, ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রাখতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েছেন। ফলে এই মুহূর্তে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত আছে। পণ্যের এলসি ও শিপমেন্টও বন্ধ রাখা হয়েছে। তিন দেশের আমদানি ও রফতানিকারকরা জরুরী ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান শুরু হওয়ার দিন থেকেই ব্যবসায়ীদের এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দেশে আমদানিকারকদের বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মূল কারণ, ওই দুদেশ থেকে পণ্যবোঝাই করতে কোন দেশের জাহাজ মালিক এ মুহূর্তে রাজি নয়। তারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি বাজেটে ৪৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ধরা হয়েছে। এটি এখন ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি ধরা হয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এটি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সার, গ্যাস ও জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এগুলো আমদানি করতে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ভর্তুকির অঙ্ক। ক্রমেই চাপে পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতি।
জানতে চাইলে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। তেলের মূল্য আগেই বেড়েছিল। এখন আরও বেড়েছে। এখন সরকারকে উচ্চমূল্যে তেল কিনতে হবে। গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। বেড়েছে সারের মূল্যও। রাশিয়া থেকে গম আমদানি করা হয়। সেটির দামও বেড়েছে। রাশিয়ার ওপর দিয়ে জাহাজ ও বিমান চলতে পারবে না। ব্যবসায়ীদের বিকল্প বাজার ও রাস্তা ব্যবহার করে পণ্য আনতে হবে। করোনার কারণে জাহাজ ভাড়া আড়াইগুণ বেড়েছিল। যুদ্ধের কারণে আরও বাড়বে। বাড়বে বিমান ভাড়াও। সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রফতানির পয়েন্ট থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। আমদানির ক্ষেত্রে তুলা, গমসহ কিছু পণ্য আনা হয়। এখন এসব পণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে। রাশিয়ার সম্পদ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও পণ্য পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের বাণিজ্যে কিছুটা চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে পারে। কারণ নিউক্লিয়া সংক্রান্ত পণ্য রাশিয়া থেকে আনা হচ্ছে। পণ্য পরিবহনে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। কিন্তু তবে যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের চাপের মধ্যে ফেলবে।