কাজিরবাজার ডেস্ক :
সরবরাহ কমে যাওয়ায় অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার। পবিত্র রমজান মাস ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইস্যু সামনে রেখে এ খাতের মিলার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা নতুন করে ভোজ্যতেল নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। এমনকি, ভোক্তাদেরও অতিরিক্ত কেনার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় মজুদ বাড়িয়ে বেশি মুনাফার আশায় মিলগেট থেকে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। খুচরা বাজারে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রতিলিটার ভোজ্যতেল ১৭-২৪ টাকা বেশি মূল্যে মানভেদে ১৬০-১৬৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দাম বেশি বাড়ার এই তথ্য সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির। তবে ঢাকার কোন কোন খুচরা বাজারে এই দামেও ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে। চাহিদামতো অর্ডার দিয়ে এখন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে খুচরায়ও সরবরাহ কিছুটা কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে এখন ব্যবসায়ীদের আমদানির সুযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া আমদানিকৃত ভোজ্যতেলের মোট মূল্যের ওপর না করে টনপ্রতি ভ্যাট নির্ধারণ করা হলে বাজারে দাম কমে আসবে।
কাস্টমসের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বীজ মাড়াই ও সরাসরি অপরিশোধিত সয়াবিনের সরবরাহ ছিল ৫ লাখ ৯০ হাজার টন। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার টন। অর্থাৎ গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দেশে ভোজ্যতেল আমদানি বেড়েছে। ভোজ্যতেল আমদানিতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়া এবং শীঘ্রই নীতিগত সহায়তা বৃদ্ধি করার আভাস পাওয়া গেছে। এ কারণে ভবিষ্যতে ভোজ্যতেলের আমদানি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ভোজ্যতেল নিয়ে করা সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড এ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সাপ্লাই চেনে বড় সমস্যার কারণে ভোজ্যতেলের দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এ কারণে প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে অতি নিত্যপণ্য ভোজ্যতেলের দাম। মিল মালিকরা উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত সরবরাহ আদেশ (সাপ্লাই অর্ডার-এসও) ইস্যু করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়াচ্ছে। ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে দ্রুত দাম নিয়ন্ত্রণ করা করা প্রয়োজন। ভোজ্যতেলের বাজারজাতকরণে শতভাগ কনজ্যুমার প্যাকের ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। আমদানিতে ভ্যাটের হার তিন স্তর থেকে নামিয়ে এক স্তরে নামিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া আগামী এপ্রিলে রমজান সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের ভোজ্যতেল আমদানি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, দেশে ভোজ্যতেলের বাজার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রধানত পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্যে পাম অয়েল পরিশোধিত অবস্থায় এনে বাজারজাত হচ্ছে। অন্যদিকে, সয়াবিন তেল অপরিশোধিত (ক্রুড) অবস্থায় এনে দেশে পরিশোধন করে তারপর বাজারজাত করছেন উদ্যোক্তারা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা ভোজ্যতেলের বাজারে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে টি কে গ্রুপ, সিটি, এস আলম ও মেঘনা গ্রুপ। সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপও ভোজ্যতেল আমদানি করে বাজারজাতকরণ শুরু করেছে। এর মধ্যে টি কে গ্রুপ রয়েছে শীর্ষস্থানে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আমদানি শুল্কায়ন বিবেচনায় নিলে গত এক বছরে ভোজ্যতেল আমদানির ৯০ শতাংশই এ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের অধীনে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠানের বাইরে সরকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেও ভোজ্যতেল আমদানি করে বাজারজাত করতে পারে। এতে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতে পারে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এর একটি বিশেষ সুবিধা পাওয়া গেছে। এদিকে, ভোজ্যতেল বাজারের সিংহভাগ পাম অয়েলের দখলে থাকলেও বাসাবাড়িতে বোতলজাত সয়াবিন তেলের চাহিদাই বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে ভোজ্যতেল আমদানি হচ্ছে প্রধানত বাণিজ্যিক ও শিল্প সুবিধার ভিত্তিতে। এর মধ্যে শিল্প খাতে দেয়া সুবিধা ভোগ করছে দেশের শীর্ষ কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো শুরুতেই কর পরিশোধ না করে ট্যাংকে রাখা তেল খালাসের সময় ধাপে ধাপে পরিশোধের সুযোগ পায়। পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল অপরিশোধিত ও পরিশোধিত আকারে আমদানি হয়। অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা ভোজ্যতেল স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। দেশের বাজারে ব্যবহার ও আমদানি বেশি হয় প্রধানত পাম অয়েল।
এদিকে, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাড়তে শুরু করে ভোজ্যতেলের দাম। এখন দেশে সর্বোচ্চ দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে। প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন ১৬০-১৬৭ এবং পাঁচ লিটারের ক্যান ৭৯০-৮০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, এক বছরে প্রতিলিটার ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে ৩৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও আমদানিকারক ও মিল মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে এর প্রভাব পড়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে এখন সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি বিরাজ করছে ভোজ্যতেলের কেনাকাটায়। আগামী এপ্রিল মাস থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু হতে যাচ্ছে। ওই সময় আড়াই থেকে তিন লাখ টন তেলের বাড়তি চাহিদা বাড়বে। এ কারণে ভোজ্যতেল নিয়ে ক্রেতা পর্যায়ে উদ্বিগ্ন সবচেয়ে বেশি।
বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় ভোজ্যতেলের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো বলেন, মিলগেটে তেলের সরবরাহ কমে গেছে। চাহিদামতো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সঙ্কট আরও বাড়ছে। তিনি বলেন, অর্ডার দেয়ার পর মাস পেরিয়ে গেলেও ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হয় না। ফলে পাইকারি বাজারে তেলের সঙ্কট আছে। খুচরা বিক্রেতারা পাইকারদের কাছ থেকে ভোজ্যতেল কিনে থাকেন। দাম কমানো এবং বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে মিলগেটে চাহিদামতো তেলের জোগান দিতে হবে। অবশ্য পাইকারি ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগ নাকচ করে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, মিলগেটে সরবরাহ কমানোর দাবি সঠিক নয়। তাদের মিল থেকে প্রতিদিন ২ থেকে থেকে আড়াই হাজার টন ভোজ্যতলে সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে, সরকারকে এক প্রকার চাপে ফেলেই সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে নিয়েছে ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়ানোর দাবি পূরণ না হলে পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে ভোজ্যতেল আমদানি করা হবে না বলে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছিল রিফাইনাররা। নতুন করে খোলা হবে না ঋণপত্র (এলসি)। এ ক্ষেত্রে ভোগ্যপণ্য তৈরির সবচেয়ে বড় উপকরণ ভোজ্যতেলশূন্য হয়ে পড়তে পারে নিত্যপণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা আরও বড় ধরনের কারসাজির আশ্রয় নিতে পারেন। এই শঙ্কা দূর করতে সম্প্রতি কয়েক দফা বৈঠকের পর রিফাইনারদের দাবি মেনে দেশের খচুরা বাজারে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ৮ টাকা বেড়ে ১৬৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৭ টাকা বেড়ে ১৪৩ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটার তেলের দাম ৩৫ টাকা বেড়ে ৭৯৫ ও পাম তেলের দাম ১৫ টাকা বেড়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটিই এ যাবতকালের ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ দাম। এখন সরকার নির্ধারিত এই দামে বাজারে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে না।
সরকার নতুন করে যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সেই দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। যেমন- বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন তেলের নতুন দাম ১৬৮ টাকা। খুচরা বাজারে কোন কোন ব্র্যান্ডের এই তেল এখন ১৭০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার ১৪৩ টাকার পরিবর্তে ১৬০-১৬৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১৭-২৪ টাকা বেশি। যদিও করোনা মহামারীর এই সময়ে ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় দাম পড়তির দিকে রয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কি ধরনের প্রভাব বাজারে পড়বে- তা এখনও অনুমান করা যাচ্ছে না। তবে বিষয়টির দিকে নজর রাখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই ইস্যু সামনে এনে এখনই তেলের দাম বাড়ানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পুরো বিষয়টি সরকারের নজরদারির মধ্যে রয়েছে। দেশে সব ধরনের ভোজ্যতেল ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের আমদানি ভাল। রোজা সামনে রেখে ইতোমধ্যে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনেক পণ্য খালাস করছেন। এ কারণে ভোজ্যতেল নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই। দেশে সন্তোষজনক মজুদ রয়েছে।
কিন্তু নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এদিকে, দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য ধারাবাহিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। এর কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো বলছে, ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) একাধিক স্তরের হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের আমদানি মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাটের চাপও বেশি পড়ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট থেকে ভোজ্যতেলের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ শুরু হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে ওই দামের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট ও কর আদায় করলে স্থানীয় বাজারেও দাম বাড়ে। এ অবস্থায় ভোজ্যতেল আমদানিতে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে তার ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করার একটি প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আমদানি মূল্যের ওপর ভ্যাট আরোপের পরিবর্তে টনপ্রতি দাম নির্দিষ্ট করে দিয়ে ওই দামের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করা প্রয়োজন। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লেও করের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। এতে করে ভোক্তাদের অতিরিক্ত করের বোঝা টানতে হবে না।