ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির ॥ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি স্থগিত

8

কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। পণ্যের এলসি ও শিপমেন্টও বন্ধ রাখা হয়েছে। তিন দেশের আমদানি ও রফতানিকারকরা জরুরীভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান শুরু হওয়ার দিন থেকেই ব্যবসায়ীদের এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দেশে আমদানিকারকদের বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মূল কারণ ওই দুদেশ থেকে পণ্যবোঝাই করতে কোন দেশের জাহাজ মালিক এ মুহূর্তে রাজি নয়। তারা সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
এদিকে এর জের হিসেবে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি হয়ে আসে এমন কিছু পণ্যের মূল্য ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। এছাড়া মূল্য বেড়েছে কিছু ভোগ্যপণ্যের। যার মধ্যে বৃহৎ আমদানির গম অন্যতম। দেশে ভোগ্যপণ্যের একক বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে বৃহস্পতিবার ভোরে। এর কয়েকদিন আগ থেকে চলছিল ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশ। পাশাপাশি চলছিল নানা ধরনের হুমকি-ধমকি ও দাবির বক্তব্য। উদ্ভূত অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে রাশিয়া, ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি কার্যক্রম স্থগিত রাখতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েছেন।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ট্রেড এ্যান্ড কমার্স সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত আমদানি হয়ে আসে এমন পণ্যের মধ্যে আমদানি হয়ে আসে গম, ভুট্টা, সরিষা, মসুর ডাল ইত্যাদি। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বছরে গমের চাহিদা রয়েছে সর্বোচ্চ ৭০ লাখ টন। এ গম প্রক্রিয়াজাত করে ময়দা, আটা, সুজিসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। দেশে গমের মোট চাহিদার মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি হয়ে আসে প্রায় ৩৫ লাখ টনেরও বেশি। অর্থাৎ চাহিদার অর্ধেক। চাহিদার অবশিষ্টাংশ অন্যান্য দেশ থেকে অর্থাৎ ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে আমদানি করে থাকে দেশের ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের বড় আমদানিকারকদের সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রতিবছর রমজানকে কেন্দ্র করে গম, ভুট্রা, ছোলা, মটর, চিনিসহ বিভিন্ন পণ্য স্বাভাবিক সময়ের চাহিদার তুলনায় বাড়তি আমদানি হয়ে থাকে। আগামী এপ্রিলের শুরু থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষে দেশের ব্যবসায়ীরা রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে স্বাভাবিক আমদানির উল্লেখিত পণ্যগুলোর আমদানির বুকিং কর্মসূচী সময় অতিবাহিত করছিল। ঠিক এ সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতিতে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা সে কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। উল্লেখ্য, ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। এদেশকে খাদ্যের জন্য ‘ব্রেড বাস্কেট’ বলা হয়ে থাকে।
এদিকে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার অনুসন্ধানে দেখা যায়, অধিকাংশ পণ্যের দাম বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে দর উর্ধমুখী। চালের দাম বেড়েছে প্রথমে। এরপর ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ছোলা, মটর, খেজুর, পেঁয়াজ, রসুন, গুঁড়োদুধ এবং সব জাতীয় মসলার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
পণ্যের বাজারমূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাইকারিতে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৩ টাকা যা গত সপ্তাহে দর ছিল ৭০ টাকায়। খোলা ভোজ্য সয়াবিন তেল প্রতিকেজিতে ৬ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকায়। পাম অয়েল ১৫৪-১৫৮ টাকায়, যা বেড়েছে কেজি প্রতি ৮ টাকা। এছাড়া বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ছে দফায় দফায়। সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন কোম্পানির ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৩০-৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৭০-৭৯০ টাকায়।
চিকন মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১১৩ টাকা, যা আগে ছিল ১০৫, মোটা মসুর ছিল ৭০ যা এখন ৮০ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে ছোলার দাম ৭ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। খেজুর ১০০ টাকা, যা আগে ছিল ৯০ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়, গত সপ্তাহে ছিল ৫০ টাকা। রসুনের দাম ১০ টাকা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১৩০ টাকায়। কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে এখন ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অপরদিকে চালের বাজারও অস্থির। ২৫ কেজি নাজিরশাইল প্রতি বস্তায় বেড়েছে ১৫০ টাকা। আগে ১৬শ টাকা থাকলেও বর্তমানে ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৭৭০ টাকায়। এদিকে গমের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। প্রতি কেজি গম ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মার্কস গুঁড়োদুধের কেজি ৬০০ টাকা, এক সপ্তাহে আগে দাম ছিল ৫৫০ টাকা।
অপরদিকে মশলা জাতীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এলাচির। প্রতি কেজি এলাচি এখন ১৬শ টাকা। অথচ এক সপ্তাহ আগে ১৫শ টাকা। লবঙ্গ কেজি ১২শ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল সাড়ে ১১শ টাকা। অন্যদিকে দারুচিনির দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে এখন ৩৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ চিত্র পাইকারি। তবে খুচরা বিক্রির চিত্রে একেক স্থানে একেক ধরনের।
অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাল্ক এবং ছোট আকারে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সর্বত্র এক ধরনের অজানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা নিশ্চিত করেছেন, কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যে বেড়েছে। যার কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধি। যার মধ্যে ভোজ্য তেল অন্যতম। ইউক্রেন ও রাশিয়া যেহেতু গমের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ সেহেতু বাণিজ্যিক কার্যক্রম ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা বাজারে আঘাম হেনেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী না হলে বাংলাদেশে এর বড় ধরনের নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। তবে স্থায়িত্ব বেশিদূর গড়ালে ভবিষ্যত কি হবে তা আগেভাগে বলে দেয়া কঠিন।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড কমার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৫ লাখ টন। মাসে ১ লাখ ১০ টন। কিন্তু রমজানের এক মাসে এর চাহিদা বেড়ে গিয়ে আড়াই লাখ টনে উন্নীত হয়। চিনির চাহিদা মাসে থাকে ১৫ লাখ টন। রমজানে তা ১৮ লাখে উন্নীত হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ডালের চাহিদা রয়েছে বছরে চার লাখ টন। ছোলা ১ লাখ ২০ হাজার টন, রমজান মাসে এককভাবে চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টনে। এছাড়া বছরজুড়ে খেজুর চলে ২০ হাজার টন। রমজানে তা নিশ্চিতভাবে বেড়ে যায়। এসব ব্যাপার নিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় একটি অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামে ওজন স্কেলের নামে হয়রানির বিষয়টি। এটি তুলে দেয়া হলে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বহুলাংশে হ্রাস পাবে বলে তাদের অভিমত।