কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে সংগ্রহ করা গ্রিল মুরগি, চিকেন তন্দুরি, চিকেন টিক্কা কাবাব, চিকেন ফ্রাই, বিফ কাবাব, বিফ গ্রিল এবং গ্রিল করা মাছে এডক্রলামাইড নামে এক সম্ভাব্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিকের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির তথ্য উঠে এসেছে এক গবেষণায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছে গবেষণাটি।
গবেষণা নিবন্ধটি ‘ডিটারমেনেশন অব এডক্রলামাইড কনটেন্টস ইন গ্রিলড মিট অ্যান্ড ফিশ ফুডস থ্রু গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ট্যানডেম ম্যাস স্পেকট্রোমেট্রি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ‘ওরিয়েন্টাল জার্নাল অব কেমিস্ট্রি’র ৩৭(৫) ভলিয়্যুমে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিআইআরসি) সিনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার জি এম এম আনোয়ারুল হাসান, খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের (আইএফএসটি) মোহাম্মদ এ সাত্তার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহবুবুল মোর্শেদ এবং হাইটেক হেলথ কেয়ার লিমিটেডের অনুজ কুমার দাস।
গবেষণার ফলাফলে উঠে আসে, গড়ে প্রতিকেজি চিকেন তন্দুরিতে ৯৯, চিকেন টিক্কা কাবাবে ৮৩, বিফ গ্রিলে ৮১, গ্রিল করা মুরগিতে ৮০, চিকেন ফ্রাইয়ে ৭৪, গরুর কাবাবে ৬৮ এবং গ্রিল করা মাছে ৪৮ মাইক্রো গ্রাম এডক্রলামাইড পাওয়া গেছে। রান্নার সময় তাপের কম-বেশিতে এডক্রলামাইডের পরিমাণে পার্থক্য হয় বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা প্রতিকেজি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারে ৫ থেকে ৫০ এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারে ১৫০ থেকে ৪০০০ মাইক্রো গ্রাম এডক্রলামাইড পাওয়া গেছে। ফ্রাইড চিপসে ১০ হাজার মাইক্রো গ্রাম পরিমাণে এডক্রলামাইডও পাওয়া গেছে। যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত প্রাত্যহিক এডক্রলামাইড ভক্ষণ মাত্রা প্রতি কেজিতে ০.৩ থেকে ২ মাইক্রো গ্রাম।
গবেষণায় বলা হয়, মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বৈশ্বিক সংস্কৃতির কারণে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসছে। তরুণ প্রজন্মের কাছে ভাজাপোড়ার মতো ফাস্টফুড অধিক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। কিন্তু এসব খাবারে রান্নায় অধিক তাপ, আলো, অক্সিজেন এবং দ্রবীভূত পিএইচসহ বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন আসায় তাদের পুষ্টিমান নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে অধিক তাপমাত্রায় তেলে ভাজার কারণে এসব খাবারে প্রাকৃতিকভাবে এডক্রলামাইড নামে রাসায়নিক পদার্থটি উৎপাদিত হয়।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, এডক্রলামাইড একটি বর্ণহীন, ঘ্রাণহীন এবং পানিতে দ্রবীভূত স্ফটিকাকার কঠিন পদার্থ। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পটেটো চিপস, সিরিয়াল, রুটি প্রভৃতি খাবারের ফ্রাইং, রোস্টিং এবং বেকিং করার সময় এটি উৎপন্ন হয়।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসে রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট থেকে ১০৫টি নমুনা সংগ্রহ করে এ গবেষণা চালানো হয়।
নিবন্ধটির গবেষক ড. মো. মাহবুবুল মোর্শেদ বলেন, ইঁদুরের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা দেখা গেছে, রাসায়নিকটির প্রভাবে ডিএনএতে ক্ষতিসাধন ও ক্যানসারের সৃষ্টি হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এটি মানুষের বেলায়ও হতে পারে; যদিও এখনো এর পেছনে কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ রাসায়নিক স্নায়ুতন্ত্র ও প্রজনন-প্রক্রিয়ায় ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, যেহেতু রাসায়নিকটি রান্নার সময় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়, তাই খাবার থেকে এডক্রলামাইডকে শতভাগ দূর করা অসম্ভব। তবে কীভাবে সেটি রান্না করা হচ্ছে, তার তাপমাত্রা, ব্যবহৃত তেলটি এর আগেও ব্যবহার করা হয়েছে কি না-এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা দরকার।
আন্তর্জাতিক এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টেক্সিকোলজি প্রোগ্রাম এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইনভাইরনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি এডক্রলামাইডকে ‘মানব শরীরে সম্ভাব্য ক্যানসার সৃষ্টিকারী (কারসিনোজেন)’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি, ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি অথরিটিসহ খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা এডক্রলামাইডের ওপর আরও বেশি গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন।