কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিরোধী রাজনীতিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন-কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা-বৈঠক চললেও এ পর্বে অনেকটাই অনুপস্থিত দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। দৃশ্যত কওমি মাদ্রাসানির্ভর দলগুলো ক্ষমতাসীন বা বিরোধী কোনওদিকেই ঝুঁকছে না। উপরন্তু কিছু দলের নেতারা কারাগারে থাকায় তারা সরকারকেও চটাতে নারাজ। তারা আপাতত চাইছেন যেকোনও মূল্যে দলের নেতাদের মুক্ত করে আনতে।
ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়তুল উলামাসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিটি দলই বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন। পরস্পরের সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ে যোগাযোগ হলেও দলীয়ভাবে যোগাযোগ হচ্ছে না। পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় তারা কোনও সিদ্ধান্তও নিতে পারছে না। কোনও দল পরিষ্কার করেই জানিয়েছে, কেবল জোটের জন্য জোট তারা করবে না।
হেফাজতের মামলায় কারাগার থেকে কিছু দিন আগে মুক্তি পেয়েছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। ণ্ডতিনি বলেন, ‘আমরা এখনও নির্বাচন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি। উপরন্তু কোনও আলোচনা হয় নাই। আমরা চাইছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সিদ্ধান্ত নিতে।’
আহমদ আবদুল কাদের জানান, খেলাফত মজলিস আপাতত দলীয় কার্যক্রম শক্তিশালী করার কাজে রয়েছে। দলটির নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাশেমীর ভাষ্য, খেলাফত মজলিসের রুটিন কাজ করা হচ্ছে। নতুন কর্মী সংগ্রহ চলছে। কর্মীদের প্রশিক্ষণমূলক কর্মশালা চলছে।
আহমদ আলী কাশেমী জানান, আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে, তা এখনও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। নির্বাচনকালীন সরকারের সময় এলে স্পষ্ট হবে কী করণীয়। জোটে হবে নাকি এককভাবে নির্বাচন করা হবে, তা জানা যাবে।
ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমাদের কথা পরিষ্কার- ইসলামি নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করা আমাদের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে যারা কাজ করবে আমরা তাদের সঙ্গেই থাকবো। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, বেশ কিছু ইসলামি দল অন্য দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকারে গিয়েছিল। কিন্তু তারা ইসলামের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছুই করতে পারেনি। আমরা এমন এমন ক্ষমতা চাই না।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘নির্বাচন বা জোট গঠন এসব নিয়ে নীতিনির্ধারণী ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়নি। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছি। আগামী মার্চের ৫ তারিখ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনা হবে।’
ধর্মভিত্তিক অন্তত ছয়টি দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, পরিস্থিতি নিয়ে এখনও অন্ধকারে ধর্মভিত্তিক দলগুলো। বিশেষত, একদিকে সরকারের চাপ পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক জোটের আন্দোলনের বিষয়টিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
নিবন্ধিত একটি ধর্মভিত্তিক দলের মহাসচিব আলাপে উল্লেখ করেন, নির্বাচনের বিষয়টি এখনও পরিষ্কার না আমাদের সামনে। বিদেশি নিষেধাজ্ঞা এলেও আগামী দিনের পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন যদি জমে উঠে বা সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে একরকম। আর যদি যেভাবে এখন চলছে তেমন হয়, তাহলে আগের মতোই হবে; এই মুহূর্তে সরকারের চাওয়ার বাইরে যাওয়া সহজ নয়।
আরেকজন সিনিয়র নেতা মনে করেন, ইসলামি দলগুলো সামনের দিনে সরকারের পরিকল্পনার সঙ্গে চিন্তা করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিনের ভাষ্য, নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে তার দলের আগ্রহ নেই। তিনি মনে করেন, এ বিষয়ে সরকার ইচ্ছে মতোই সব করবে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের শরিক নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা একেএম আশরাফুল হক বলেন, ‘সবাই শীতল, নাড়াচাড়া নাই। ইসলামি দলগুলো এখন অন্তর্মুখী, কর্মসূচি দেওয়ার কোনও পরিবেশ পাচ্ছে না। নিজস্বভাবেও আন্দোলন করার অবস্থানে নেই, বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করতেছে।’
‘কেউ বিএনপির সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে পারছে না। কেউ সরকারের সঙ্গেও করছে না- এমনটা উল্লেখ করে আশরাফুল হকের মন্তব্য, ‘নিজেদের মধ্যে দূরত্ব অনেক, অবিশ্বাস আস্থাহীনতা রয়েছে। বাইনেম আওয়ামী লীগের জোটে যাওয়ারও সুযোগ নেই। বিএনপি থেকেও সবাই বেরিয়ে আসছে। সরকারের বিরোধী অবস্থানে থাকবে, এটার সুযোগ হচ্ছে না। ইসলামন্থীরা স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে পারে।’
নায়েবে আমির মজিবুর রহমান হামিদী জানান, ইসলামি সমমনাদের কোনও জোট হলে তার দল সেই জোট নিয়ে আগ্রহী।
প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদউদ্দীন মাসঊদের পর্যবেক্ষণ, ইসলামি দলগুলো হয়তো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। নির্বাচনের বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে আসে নাই। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হবে। এরপর হয়তো স্পষ্ট হতে পারবে।’
‘যেকোনও শর্তে মামুনের মুক্তি চায় মজলিস’
গত বছরের এপ্রিলে গ্রেফতার হয়েছিলেন আলোচিত বক্তা বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। তার মুক্তির বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেনদরবার-তদবির-যোগাযোগ করলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, মামুনুল হকের মুক্তির বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ চাপ রয়েছে। এছাড়া দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, মাওলানা কোরবান আলী, মাওলানা এহসানুল হকসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জে বেশ কয়েকজন নেতা কারাগারে রয়েছেন। দলীয়ভাবে তাদের মুক্তির বিষয়টিও সামনে আনার চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে মাওলানা মামুনুল হকের ভাই, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মাহফুজুল হক ণ্ডবলেন, ‘দলীয়ভাবে তার মুক্তির বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে, চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে প্রাথমিক কোনও আশ্বাসও পাওয়া যাচ্ছে না।’
দলীয় আরেকটি সূত্র বলছে, সরকারের সঙ্গে চলমান আলোচনায় যেকোনও শর্তেই মামুনুল হকের মুক্তি চায় খেলাফত মজলিস। সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনাকালে বিষয়টি উপস্থাপন করছেন দলটির নেতারা।
এ প্রসঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন ণ্ডবলেন, ‘আমরা চাই সরকার তাকে দ্রুত মুক্তি দিক। এজন্য আইনগতভাবে লড়াই চালিয়ে যাবো। একইসঙ্গে সরকারের উচ্চমহলের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে আলাপ আলোচনা করবো। কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে আগাবো, সেটা দলীয় ফোরামে আলোচনার পর চূড়ান্ত বলা যাবে।’
‘ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যোগাযোগ করছে বিএনপি’
ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম প্রধান নেতা জানিয়েছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে। তবে বিএনপি-জোট ছেড়ে আসা খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে সরাসরি কোনও যোগাযোগ না হলেও বিভিন্নভাবে ‘ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে’ যোগাযোগ করা হচ্ছে, এমন দাবি করেছেন একটি দলের মহাসচিব।
ধর্মভিত্তিক একটি দলের অন্যতম প্রধান নেতা দাবি করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছে। দলটির অন্যতম প্রধান একনেতাকে ইসলামি দলগুলোকে সমন্বয় করার জন্য মত দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে দলটির নায়েবে আমির মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ‘আমার জানামতে বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের কাছে কোনও প্রস্তাব আসেনি।’
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা মতবিনিময় নিয়ে ভাবছি না।’
জমিয়তের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘আমরা তো কোনও জোটে নেই। স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভবিষ্যতে অগ্রসর হবো।’
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যকে ফোন করা হলেও কারও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।