মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :
মানুষ পৃথিবীতে নির্দিষ্ট আয়ুস্কাল নিয়ে বিচরণ করে, অতঃপর আল্লাহর বিধানে পরপারের যাত্রী হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে বাধ্য। মানবজীবনের এখানেই পরিসমাপ্তি নয়, কিংবা এতেই মানব সৃষ্টির লক্ষ্য পূরণ হয় না। বরং সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনেই রাব্বে কারিম মানুষ’কে সৃজন করেছেন। মানুষ নির্দিষ্ট আয়ুস্কালের মধ্যেও অনেক বান্দা সফলতা লাভ করে, কেউ সম্পদের সমৃদ্ধি দিয়ে আবার কেউ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ সন্তুষ্টি দিয়ে। নির্ধারিত মেয়াদে মানুষকে কিছু বিষয়ে পরীক্ষা করাও মহান রবের অন্যতম উদ্দেশ্য।
সেই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে, সাফল্যের পরিচয় দেবে; তাঁদের জন্য রয়েছে রাব্বে কারিমের মহান পুরস্কার ও সুসংবাদ। রাব্বে কারিম কর্তৃক গৃহীত মানবজীবনে এসব পরীক্ষা ও প্রাপ্ত সুসংবাদ সম্বন্ধে ইরশাদ হচ্ছে- আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলাদির ক্ষয়ক্ষতির দ্বারা। এহেন বিপদগ্রস্ত অবস্থায় যারা ধৈর্য ধারণ করবে, তাদের সুসংবাদ দাও। (সূরা: বাকারা-১৫৫)।
প্রত্যক মুসলিম নর-নারীর সবচেয়ে বড় সফলতা ও মানদন্ড হচ্ছে মহান আল্লাহ ভয় অর্জন করা এবং রাসূল (সাঃ) আদর্শে আদর্শবান হওয়া। মানুষকে পরীক্ষা করা হবে ভয় দ্বারা। আমাদের জীবনে কোনো একটা মুসিবত এসেছে বা আসবে, যা নিয়ে আমরা আতঙ্কে থাকি বা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাই। এ ভয় পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক- যে কোনো ধরনের বিপদ থেকে হতে পারে। বস্তুত আল্লাহ’র প্রিয় মানুষদেরই অধিকতর পরীক্ষার সম্মুখীন করে থাকেন- তাদের মধ্যে নবী-রাসূল, অলি-গাউস-কুতুব, সুফি-সাধক, বুজুর্গসহ আল্লাহ’র প্রতি অনুগত ও একনিষ্ঠ মানুষদের নানাবিধ উপায়ে ইহজাগতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। ইরশাদ হচ্ছে- আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ’কে ভয় করে এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাঁরাই কৃতকার্য। (সূরা: নূর-৫২)।
ইসলামের সূচনা থেকে আজ অবধি মুসলিম সমাজে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কষ্ট যেন নিত্যসঙ্গী। ক্ষুধা বা দারিদ্র্য মানবজীবনের আরেকটি পরীক্ষা। রাসূল (সাঃ) যুগেও ক্ষুধার যন্ত্রণায় অনেকেই পেটে পাথর বাঁধলেও বর্তমান সমাজে আগের সেই অবস্থা নেই। তারপরও দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে আমরা মুক্ত নই। অভাব-অনটন, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানুষ তার বিবেক ও চরিত্র বিসর্জন দেয় কিনা, মহান আল্লাহ সেই পরীক্ষায় আদম সন্তানকে ফেলে দেন। অভাব যাদের নিত্যসঙ্গী, ক্ষুধা যাদের জীবনে লেগেই থাকে, তারা পুরোপুরি কৃতজ্ঞশীল হয়ে শান্তি নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে সমর্থ হয় না।
সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সফলতা লাভ করে অঢেল সম্পদের মালিক কখনও রাস্তার ভিখারি হয়ে; সম্পদশালী ব্যক্তি কোনো কারণে নিঃস্ব হয়ে যাবেন। এটিকে আল্লাহ এক নির্ধারিত পরীক্ষা হিসেবে আমলে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সম্পদের একচ্ছত্র মালিকানা মহান আল্লাহ’র; এটি কারও কাছেই চিরস্থায়ী নয়- এ চির সত্য মেনে নিতে হবে। সম্পদ হাতছাড়া হলেই মাতম শুরু করা চলবে না, বরং পরম আরাধ্যে তা অতিক্রম করতে হবে এবং নিজেকে বোঝাতে হবে- আল্লাহ’র পরীক্ষা চলছে। আর এ থেকে আমার উত্তরণও ঘটবে। আপনজন হারানোর বেদনার মধ্য দিয়ে যে কঠিন পরীক্ষা, তাও কাটিয়ে উঠতে হবে। সর্বদাই অন্তঃকরণে এ বিশ্বাস রাখতে হবে- জীবন-মৃত্যু একমাত্র আল্লাহ’র নিয়ন্ত্রে। তিনিই জন্ম দেন, তিনিই মৃত্যু ঘটান। একমাত্র অবলম্বন অনেক সময় ইহধাম ত্যাগ করতে পারে; জীবনটাকে তখন অর্থহীন মনে হতে পারে। চরম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তখন ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা বহন করতে হবে। প্রিয়জনের অকালমৃত্যু, অপমৃত্যু- কত কিছুই না মানবজীবনে ঘটতে পারে! এসবই মহান আল্লাহ’র পরীক্ষা হিসেবে নিতে হবে। এছাড়াও জমিনে উৎপাদিত পণ্য, ফল বা ফসলাদির নানা কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টির কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে। খাদ্যের মজুদ শেষ হয়ে যাওয়া, ঋণে জর্জরিত হওয়া, খরা বা বন্যায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়া, নদীভাঙনের কবলে পড়া, ফসলি জমি নদীতে বিলীন হওয়া- এসবই সেই প্রতিশ্রুতি পরীক্ষার অংশ। অতঃপর এ সফলতার ভাবনায় যারা আসক্ত, তাদের জন্য ইরশাদ হচ্ছে- পার্থিব দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি অনুরাগ মানুষকে ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন করে ফেলে। এ কারণে পরকাল সম্পর্কে জানা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তারা শুধু দুনিয়ার জ্ঞানেই জ্ঞানী। (সূরা: আর-রুম-৭)।
দুনিয়ার জীবন খুব মায়াবিনী এবং অল্প সময়ের ক্ষণস্থায়ী একটা পথ। এই পথ পাড়ি দিয়েই যেতে হবে চিরস্থায়ী জীবনে। কেউ জাহান্নামে, কেউ সাজসজ্জাহীন সুন্দর জান্নাতে। এবং এই মায়াবিনী দুনিয়াতে সফলতা জয় না করে যদি আল্লাহ ভয় অর্জন করা এবং রাসূল (সাঃ) আদর্শে আদর্শবান তৈরি করেন, তাহলে এটাই হবে এক জন মুমিনের সবচেয়ে বড় সফলতা।