কাজিরবাজার ডেস্ক :
দরজায় দাঁড়িয়েছিল ম্লান মাতৃভাষা/তার আঁচলের গায়ে জ্বলছিল/স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের/আকাশভ্রষ্ট তারারা/বড় বেদনার মতো দুঃখী মেঘ এসে ঢেকেছিল আঁচলের আলো …। ভাষার বুকে জেগে ওঠা সেই কালো ছায়া সরিয়ে দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। বন্দী শেকলের আবর্ত থেকে আপন শক্তিতে জেগে উঠেছিল বাংলা ভাষা। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে আপন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বাংলা মায়ের মাতৃভাষা। বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে কিনা-এমন প্রশ্ন নিয়ে যখন বিতর্ক জন্মে তখন সজাগ হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের যে রূপ দাঁড়িয়েছিল তাতে নতুন রাষ্ট্রে বাঙালি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও ভাষার প্রশ্নে বাঙালীর মতামতকে অগ্রাহ্য করেছিল শাসকগোষ্ঠী। তাই মাতৃভাষা বাংলাবিষয়ক বিতর্ক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অতিদ্রুত রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বিতর্কের পথ ধরে বিক্ষোভে পরিণত হয়। সেই বিক্ষুব্ধতারই চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ভাষা আন্দোলনে।
মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই উত্তপ্ত ছিল ঢাকার রাজপথ। তেমনই একদিন ছিল ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। এদিন ভাষার দাবিতে মিছিল হয়েছে রাজপথে। হয়েছিল ধর্মঘট। ঢাকার সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল যশোর, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায়। আর ৪ ফেব্রুয়ারি সেই ধর্মঘটের প্রেক্ষিতটা তৈরি হয়েছিল ২৭ জানুয়ারি। এদিন পল্টন ময়দানের এক জনসভায় পাক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলে ওঠেন- ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে একমাত্র উর্দু’ এবং ‘উর্দু হরফে বাংলা লিখনের প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হইতেছে’। তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তির প্রতিবাদেই ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ডেকেছিল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা এবং আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের প্রতিবাদে ডাকা সেই ধর্মঘটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টা থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সমবেত হতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া এবং আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের প্রয়াস বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। সভা শেষে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীর বিশাল মিছিল বের হয়। সেই মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে গিয়ে নবাবপুর, পাটুয়াটুলী, আরমানিটোলা, নাজিমুদ্দিন রোড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আর মিছিলের শ্লোগানে উচ্চারিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবী হরফে বাংলা লেখা চলবে না’। সেই সঙ্গে ভাষার প্রশ্নে পাকি সরকারের সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়ে ধ্বনিত হয়েছে ‘মীরজাফর নাজিমুদ্দিন মুরদাবাদ’, ‘জুলুমশাহী নিপাত যাক’, ‘বর্ণভাষা শিক্ষাসংস্কৃতির ঘাতকদের সাবাড় করো’। নাজিমুদ্দিনের ব্যঙ্গচিত্রসহ পোস্টারও ঠাঁই পেয়েছিল সেই মিছিলে। শহর ঘুরে মিছিলটি পুনরায় ফিরে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায়। সেই সময় প্রদেশব্যাপী আসন্ন ২১ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট সফল করার আহ্বান জানানো হয়। এরপর মূল মিছিলটি আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চলে যায় সেক্রেটারিয়েটের সামনে। সেই মিছিল থেকেই তিন শতাধিক ছাত্রী বেরিয়ে এসে পৃথক মিছিলের পাশাপাশি বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
৪ ফেব্রুয়ারির সেই ধর্মঘটে সৃষ্টি হয় চেতনার নবজাগরণ। ভাষার অধিকার আদায়ের উত্তাপ পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলঞ্জুড়ে। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, ফেনী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। ছাত্রদের পাশাপাশি সেসব বিক্ষোভে সম্পৃক্ত হন স্থানীয় সাধারণ মানুষ। এমনকি চাঁদপুরের এক সভায় শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন করে।