স্টাফ রিপোর্টার :
অবেশেষে ১৬৩ ঘণ্টা পর আমরণ অনশন ভাঙলেন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ শিক্ষার্থী। আন্দোলনের ১৩তম ও অনশনের ৮ম দিনে বুধবার ২৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ২০ মিনিটের সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক শিক্ষার্থীদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান। তবে অনশন ভাঙলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এর আগে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৪ মিনিটে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে আসেন। এরপর ৪টার দিকে তিনি অনশনস্থলে যান। সেখান গিয়ে তিনি অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তার স্ত্রী ইয়াসমিন হকও সঙ্গে ছিলেন।
এ বিষয়ে অনশনকারী শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল রাফি বলেন, ‘স্যার বলেছেন, তাকে আশ্বাস দিয়ে পাঠানো হয়েছে। উপাচার্যের জন্য অনশন করে নিজের ক্ষতি করা ঠিক না। তাই আমাদের অনশন ভাঙার অনুরোধ ও আহ্বান জানান তিনি। তবে আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে।’
এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ‘আমরা যেন নিজেদের ক্ষতি না করি এবং যারা অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন, যাদের অবস্থা খুব সংকটাপন্ন, সব বিষয় বিবেচনা করে আমরা যাতে অনশন ভেঙে ফেলি, সেই আহ্বান তিনি জানিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, স্যারের ওপর বিশ্বাস রেখে সবাই মিলে অনশন ভেঙে ফেলি।’
অনশনকারীদের মুখপাত্র শাহরিয়ার আবেদিন বলেন, ‘আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম ভিসির পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাব। অনশনের আজকে সপ্তম দিন হতে যাচ্ছিল। বুধবার ভোরে জাফর ইকবাল স্যার ও ইয়াসমিন ম্যাম আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তারা এসে বলেছেন, তাদের সাথে উচ্চপর্যায়ের অনেকের কথা হয়েছে। তারা স্যারকে আশ্বস্ত করেছেন আমাদের দাবির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘জাফর ইকবাল স্যার ও ইয়াসমিন হক ম্যাম আমাদের কাছে খুব শ্রদ্ধার মানুষ। তাই তারা যেহেতু অনুরোধ করেছেন, তাদের ওপর শ্রদ্ধা রেখে ও আমাদের দাবির ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এই আশ্বাস পেয়ে আমরা আপাতত আজকে অনশন কর্মসূচি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
শাহরিয়ার আবেদিন আরও জানান, ‘ভিসির পদত্যাগের দাবিতে যে আন্দোলন সেটি স্থগিত হয়নি। শুধু অনশন কর্মসূচি স্থগিত হয়েছে। আমাদের প্রায় ১৮-১৯ অনশনকারী হাসপাতালে আছেন। তাদেরকে এখানে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শাবিপ্রবির বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ এনে গত ১৩ জানুয়ারি দিনগত মধ্যরাতে ওই হলের ছাত্রীরা রাস্তায় নামেন। সেই থেকে এ আন্দোলনের সূচনা। একদিন পর ১৫ জানুয়ারি আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। এতে নতুন মাত্রা পায় আন্দোলন। হলের পুরো প্রভোস্ট কমিটির অপসারণ, অব্যবস্থপনা দূর, ছাত্রলীগের হামলার বিচার চেয়ে ১৬ জানুয়ারি শাবির আরও শিক্ষার্থী আন্দোলনে শামিল হন। সেদিন উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাকে মুক্ত করতে গেলে পুলিশকে বাধা দেন আন্দোলনকারীরা। এতে উভয়পক্ষের সংঘর্ষ হয় এবং এতে পুলিশ ও শিক্ষকসহ অর্ধশতাধিক লোক আহত হন। ১৬ জানুয়ারির সংঘর্ষের ঘটনায় দুই থেকে তিনশ’ অজ্ঞাত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ১৭ জানুয়ারি রাতে মামলা করে পুলিশ। মামলার এজাহারে পুলিশ লিখেছে, সেদিন শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর গুলিও ছুঁড়েছিল। এ মামলা প্রত্যাহারে ১৮ জানুয়ারি রাত ১০টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় ১৮ জানুয়ারি আরও উত্তপ্ত হয় শাবি ক্যাম্পাস। ওইদিন ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে অবস্থান নিয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের অপসারণ, প্রক্টর ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগানে মুখর ছিলো ক্যাম্পাস। ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ক্যাম্পাসে যান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের সাথে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশফাক আহমদ, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক বিধান কুমার সাহা ও সিসিক কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে ভিসি অপসারণের আশ্বাস না পেয়ে আন্দোলন থেকে সরার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তারা উপাচার্যের অপসারণ চেয়ে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বরাবরে চিঠি পাঠান। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯ জানুয়ারি দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন শিক্ষার্থীরা। এ সময়ের মধ্যে ভিসি পদত্যাগ না করায় পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ওইদিন বিকেল ৩টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন ২৪ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে একজনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি বাড়ি চলে যান। বাকি ২৩ জনের সাথে ২২ জানুয়ারি আরও ৫ শিক্ষার্থী যোগ দেন।
২১ জানুয়ারি দুই দফায় শাবি ক্যাম্পাসে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাদেল। তিনি শিক্ষার্থীদের সাথে মুঠোফোনে কথা বলিয়ে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে। শিক্ষামন্ত্রী অনশন ভাঙতে ও আলোচনায় বসতে আহবান জানান শিক্ষার্থীদের। আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান শিক্ষামন্ত্রী। প্রথমে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও পরে শিক্ষার্থীরা মত বদলে ফেলেন। তবে ২১ জানুয়ারি রাতে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় যায়। পরদিন ২২ জানুয়ারি তাঁরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বাসায় বৈঠকে বসেন। বৈঠকের পর শিক্ষামন্ত্রী ফের আলোচনায় বসতে শিক্ষার্থীদের আহবান জানান। ২২ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাতে শাবির আন্দোলনরতদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি আন্দোলন থেকে সরে এসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে জোর দেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর দ্বিতীয়বারের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি রাত পৌনে ৮টার দিকে শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে বিকেল থেকে তাঁর বাসা ঘেরাও করা হয়। পরদিন ২৫ জানুয়ারি রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় প্রদান করা হয়।