পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ॥ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সকল আঘাত থেকে রক্ষা করতে হবে

4
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে রাজারবাগ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইনস প্রান্তে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে “পুলিশ সপ্তাহ-২০২২” এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পূর্বসূরিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে সকল আঘাত থেকে রক্ষা করতে পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জাতির পিতার দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, যা আমাদের এই স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, আপনাদের পূর্বসূরিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীনতাকে সকল আঘাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
রবিবার ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০২২’ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমার বিশ্বাস জনবান্ধব পুলিশিংয়ের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে প্রত্যেক পুলিশ সদস্য পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। সর্বোপরি পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন অনুষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশকে শান্তির সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে নব উদ্যমে কাজ করতে প্রেরণা যোগাবে- এটাই আমার প্রত্যাশা।
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ পরিবেশন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে একটি খোলা জিপে প্যারেড পরিদর্শন এবং সালাম গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কৃতি পুলিশ সদস্যদের মাঝে পুলিশ পদকও বিতরণ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে ২০২০ সালে ১১৫ এবং ২০২১ সালে ১১৫ জনসহ মোট ২৩০ পুলিশ সদস্যকে পদক প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে ৯ জনকে মরণোত্তর পদক প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে র‌্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও রয়েছেন। পদকের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)- সেবা, রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম), রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচন বানচালের নামে করা অগ্নিসন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস, নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন, রাস্তা কেটে ফেলা- নানান ধরনের কাজ তারা করেছে, এমনকি পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে। যেভাবে পুলিশের সদস্যদের তারা নির্মমভাবে মেরেছে- সেটা সত্যিই ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এই ধরনের ঘৃণ্য কাজ করে তারা দেশে একটা অশান্ত পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিল। কত মানুষকে তারা হত্যা করেছে, তার কোন সীমা নেই। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় সাহসীকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকবেলায় পুলিশ সদস্যদের ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, সেই সময় পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানুষের জীবনে শান্তি, নিরাপত্তা নিয়ে এসেছে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তারা কাজ করেছেন। এ জন্য সবাইকে তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি পদকপ্রাপ্তদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যরাও ভাল কাজ করে যাবেন বলে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব মন্দার পর এসেছে করোনা, এত প্রতিকূলতার মাঝেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশে প্রায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হয়েছে, ব্যাপকভাবে যোগোযোগ ব্যবস্থা এবং আর্থসমাজিক উন্নয়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক করে দিচ্ছে এবং দায়িত্ব পালনে বিশেষ সুবিধার সৃষ্টি করে দিচ্ছে সরকার। তার সরকার এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতির পিতার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করাই তার সরকারের লক্ষ্য।
সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা জাতির পিতার ভাষণের উদ্ধৃতি তুলে ধরে পূর্বসূরিদের ঐতিহ্য ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যও পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন অনুষ্ঠানের ভাষণে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘এই রাজারবাগে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের কথা মনে রাখতে হবে। তারা আপনাদেরই ভাই, তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’
’৭৫-এর বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুলিতে আহত ছিলেন আমার ফুফু এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের ছেলে, স্ত্রীসহ আমার ফুফাত ভাই ও বোনেরা। যখন এই খুনীরা আক্রমণ করে চলে যায় তখন রমনা থানা থেকে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তাদের বাড়িতে গিয়ে আহত-নিহতদের হাসপাতালে নিয়ে যান। শুধুমাত্র পুলিশের এই সাহসী ভূমিকায় আমার ফুফু বেঁচে ছিলেন। তিনি পঙ্গু অবস্থায় বাকি জীবন কাটান। আমার দুই ফুফাত বোন এবং ভাই বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হামলায় বাধা দিতে গিয়ে গুলিতে নিহত পুলিশের বিশেষ শাখার এএসপি সিদ্দিকুর রহমানকে তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর ছয় বছর তাকে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ রিফিউজি জীবন কাটাতে বাধ্য হন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাকে সভাপতি নির্বাচন করায় দেশে ফেরেন তিনি। তখন জাতির পিতার খুনীরা ক্ষমতায়, তথাপি দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সংকল্প নিয়ে এক রকম জোর করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
পুলিশের উন্নয়নে তার সরকারের গৃহীত উন্নয়ন কর্মকা-ের সংক্ষিপ্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালের প্রথম মেয়াদেই তার সরকার ৫ কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে। বিভিন্ন স্থানে থানা, তদন্ত কেন্দ্র, হাইওয়ে ফাঁড়ি, পুলিশ ক্যাম্প এবং পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ করে। পাশাপাশি ৮০৩ জন এসআই, ৫০৭ জন সার্জেন্ট এবং ১৪ হাজার ৬৮০ জন কনস্টেবল নিয়োগ করে ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে কমিউনিটি পুলিশ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে গত ১৩ বছরে পুলিশের উন্নয়নে নানাবিধ কর্মকা- গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে মোট ৮২ হাজার ৫৮৩টি নতুন পদ সৃজন করা হয়েছে। পুলিশের নতুন ইউনিট যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল-ট্যুরিস্ট- নৌ পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন, এ্যান্টি টেরোরিজম ও কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, রংপুর ও ময়মনসিংহে রেঞ্জ, রংপুর এবং গাজীপুরে মেট্রোপলিটন পুলিশ ইউনিট, রংপুরে আরআরএফ এবং সিআইডিতে সাইবার পুলিশ সেন্টার গঠন করা হয়েছে। ২টি সিকিউরিটি এ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন, এয়ারপোর্টে একটি ও কক্সবাজারে ২টি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং র‌্যাবের জন্য ৩টি ব্যাটালিয়ন, ৩০টি ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, ৬২টি থানা, ৯৫টি তদন্ত কেন্দ্র এবং একটি ফাঁড়ি এবং জাতীয় জরুরী সেবায় ৯৯৯ ইউনিট গঠন করা হয়েছে। জরাজীর্ণ থানাগুলো পুনর্র্নিমাণ করা হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, আমরা আইজিপির র‌্যাঙ্ক ব্যাজ পুনর্প্রবর্তন করেছি। গ্রেড-১ এর ২টি, গ্রেড-২ এর ১১টি, ডিআইজির ৫২টি, অতিরিক্ত ডিআইজির ১৫৯টি, পুলিশ সুপারের ৪০২টি এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ৮০০টি পদ সৃজন করেছি। ২১৫টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদকে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে, ২৫৩টি সিনিয়র এএসপি পদকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে, এসআই/সার্জেন্ট পদকে তৃতীয় শ্রেণী হতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এবং ইন্সপেক্টর পদকে দ্বিতীয় শ্রেণী হতে প্রথম শ্রেণীর নন-ক্যাডার পদে উন্নীত করেছি। সংশোধিত নিয়োগ বিধিমালার আলোকে স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্প্রতি ৩ হাজারের অধিক কনস্টেবল নিয়োগ করেছি। আকাশপথে সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে দুটি হেলিকপ্টার ক্রয় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
অপরাধ তদন্তে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২২টি নতুন ব্যারাক, ১০টি একাডেমিক ভবন, বিভিন্ন ইউনিটের জন্য ১০৪টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ, ৬০টি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণ, রাজস্ব বাজেট থেকে ২৭টি থানা নির্মাণ, ২৮টি ফাঁড়ি, ১৫টি তদন্ত কেন্দ্র, ৩৩৭টি থানার হেল্প ডেস্ক, ৪৫টি হাইওয়ে আউটপোস্ট ভবন সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২১১টি আধুনিক থানা ভবন নির্মাণ, ৯৫টি থানাকে মডেল থানায় উন্নীতকরণ, ২১টি ব্যারাক ভবন ও ৬০টি তদন্ত কেন্দ্র নির্মাণের তথ্যও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, এখন পুলিশ বাহিনী প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন পুলিশ বাহিনীতে উন্নীত হয়েছে। সকল র‌্যাঙ্কের পুলিশ সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিবছর ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন যুগোপযোগী ট্রেনিং মডিউল প্রণয়ন, ট্রেনিং মডিউলের মধ্যে মানবাধিকার সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বৈদেশিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জরুরী সেবা ‘৯৯৯’ চালু করার ফলে আজকে পুলিশ বাহিনী দ্রুত সেবায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছে। যে কারণে আজকে মানুষের মধ্যে একটা আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ সদস্যদের আর্তমানবতার সেবায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রশংসা করেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে পুলিশ বাহিনীর অংশগ্রহণ বিশেষ করে নারী সদস্যদের দায়িত্ব পালনেরও প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।