কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পণ্য রফতানিকারকদের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং বাণিজ্যের প্রসারে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও নিজস্ব ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য গবেষণায় মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নিজের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য আপনাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। পণ্যের গুণগত মান ধরে রেখে যেন বাজার ঠিক রাখতে পারেন, আরও উন্নত করতে পারেন, সেদিকে আপনারা অবশ্যই দৃষ্টি দেবেন। অর্থাৎ নিজস্ব ব্র্যান্ডিং সৃষ্টি করে আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে।
শনিবার ‘২৬তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর পূর্বাচলে নবনির্মিত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের গবেষণা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন পণ্যের কেমন চাহিদা, কোন্টির মান কোন ক্ষেত্রে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থাৎ নিজস্ব ব্র্যান্ডিং সৃষ্টি করে আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক কূটনীতির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রতিটি দূতাবাসকে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং সমন্বিত অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে ২৩টি দেশের বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করেছি। অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সভাপতিত্ব করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন এবং ইপিবি’র ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ড এবং মেলা নিয়ে ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ‘আইসিটি পণ্য ও সেবা’-কে জাতীয়ভাবে ‘বর্ষ পণ্য’ ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি গবেষণাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেই। আমার মনে হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের আরও গবেষণা দরকার। আমাদের পণ্য চাহিদা এবং পণ্য মান সেগুলো বিশেষভাবে নিরূপন করা এবং রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের মান ধরে রাখার বিষয়ে প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প মালিক এবং উদ্যোক্তাদের আমি অনুরোধ করব, নিজের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য আপনাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে প্রযুক্তির যুগ বিশ^ এগিয়ে যাচ্ছে, ৪র্থ শিল্প বিপ্লব সামনে রেখে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতেও আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। যাতে আমরা কোনভাবেই যেন পিছিয়ে না থাকি, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।
করোনার মাঝেও অর্থনীতিকে সীমিত আকারে হলেও এগিয়ে নেয়ায় তিনি শিল্প উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে মালিক-শ্রমিক সকলকে কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, এরমাঝেও আমাদের অর্থনীতি কিন্তু একেবারে কখনও স্থবির হয়নি। স্বল্পমাত্রায় হলেও আমরা সব চালু রাখতে সক্ষম হয়েছি, যেখানে পৃথিবীর বহু দেশ কিন্তু এই সমস্যায় পড়েছে। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে তার সরকার প্রবৃদ্ধিকে ৮ ভাগে তুলতে সক্ষম হয়েছিল উল্লেখ করে ভবিষ্যতে এটি অতিক্রমেরও আশবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান কূটনীতিকে বাণিজ্যিক কূটনীতি আখ্যায়িত করে সরকারপ্রধান বলেন, ইতোমধ্যে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রত্যেকটি দূতাবাসকে সেভাবেই কাজ করার নির্দেশ দিয়েছি। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের অর্জনকে ধরে রেখে যদি সামনে কোন চ্যালেঞ্জ আসে সেটাও যেন আমরা মোকাবেলা করতে পারি, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে রফতানি হওয়া আইসিটি পণ্য ও সেবাখাত হতে ৪৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয় অর্জিত হয়েছে। এছাড়া করোনাকালীনও সার্বিক রফতানি বৃদ্ধির কথা জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় রফতানি খাতের ভূমিকা অনেক। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন, যা বাংলাদেশকে আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় মোট রফতানি আয় পেয়েছিলাম ১৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত ১৩ বছরে আমরা ৪৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছি। কাজেই এই ব্যাপক উন্নতি আমরা করতে সক্ষম হয়েছি। জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত, সমৃদ্ধ আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মমর্যাদাশীল সোনার বাংলাদেশ গঠনে তার সরকার সক্ষম হবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সময় কিন্তু আমাদের, সময়টা বাংলাদেশের, সে কথাটা মনে রাখতে হবে। আর সেই সুযোগটা আমাদের নিতে হবে। একুশ বছর পর ’৯৬ সালে প্রথমবার সরকার গঠনের পর থেকেই বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করে দেয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ যেন শিল্প-বাণিজ্য এবং রফতানি ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে সে পদেক্ষপ তাঁর সরকার গ্রহণ করে এবং নিজস্ব বাজার সৃষ্টির উদ্যোগও তাঁর সরকার নেয়। সারাদেশে ১শ’ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে অঞ্চল ভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে জনগণের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
তিনি বলেন, নিজের দেশের বাজার সৃষ্টি করার পাশাপাশি নিজের দেশের মানুষকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করা, তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কেননা আমাদের দেশের শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসার ঘটবে তখনই যখন আমাদের নিজস্ব বাজার সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ বেসরকারী খাতে উদ্যোক্তা সৃষ্টির ব্যাপক সুযোগ আওয়ামী লীগ সরকার তৈরি করে দেয়।
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের আন্তর্জাতিকভাবে নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করার এবং রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। এ সময় কৃষিপণ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপরও ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার নির্মাণের মাধ্যমে বাণিজ্য মেলার একটি স্থায়ী স্থান তার সরকার করে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী একে কাজে লাগানোর জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানানোর পাশাপাশি ছোটখাটো সমস্যাগুলো নিজেদের উদ্যোগেই সমাধান করে নেয়ার জন্য বলেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতার শেষভাগে আশা প্রকাশ করে বলেন, মাসব্যাপী আয়োজিত এই মেলা উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রফতানিকারক, ক্রেতা ও দর্শকদের মাঝে আমাদের সক্ষমতার বার্তাটি আরও জোরালোভাবে পৌঁছে দেবে।
গত বছর কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে মেলার আয়োজন করা সম্ভব না হলেও এবারই প্রথমবারের মতো স্থায়ী ভেন্যু পূর্বাচল নতুন শহরে নবনির্মিত বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ)-২০২২ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে সামনে রেখে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
পণ্যভিত্তিক রফতানিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবছর একটি পণ্যকে ‘বর্ষপণ্য’ অর্থাৎ ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের জন্য আইসিটি পণ্য সেবাকে ‘বর্ষপণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।