কাজিরবাজার ডেস্ক :
এ এক নতুন ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। ঢাকা থেকে নদীপথে বরগুনা পর্যন্ত সুগন্ধা নদী পথ রুটে লঞ্চ যাত্রায় দেশের ইতিহাসে বিরল ও মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা। সুগন্ধা নদীর এই ট্র্যাজেডিতে সারিবদ্ধ শুধু লাশ আর লাশ। নদী তীরে আহাজারি ও স্বজনহারাদের আর্তনাদ। বাতাস হয়ে আছে ভারি।
বৃহস্পতিবার শেষ রাতে সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবোঝাই চলমান একটি লঞ্চে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাতে এ ঘটনা নিয়ে শেষ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। দেশের ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা। অগ্নিকান্ডে দগ্ধসহ দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১২০ জনকে ঝালকাঠি ও বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গুরুতর আটজনকে ঢাকায় আনা হয়েছে। এদের দুইজনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্কটজনক অবস্থায় রয়েছে বহু। ঘটনার পর অকুস্থল পরিদর্শন করেছেন নৌপ্রতিমন্ত্রী, ঝালকাঠি জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ঘটনা নিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণ। প্রধানমন্ত্রী তাঁর তাৎক্ষণিক নির্দেশে আহতদের চিকিৎসা ও নিহতদের লাশ দ্রুত হস্তান্তরের নির্দেশ প্রদান করেন। ঘটনার তদন্তে নৌ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর পক্ষে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সময় তখন বৃহস্পতিবারের শেষ রাত। রাত আনুমানিক তিনটা। এর আগে ‘এমভি অভিযান-১০’ নামের একটি লঞ্চ ঢাকার সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর বরগুনার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। লঞ্চটিতে ৩২০ যাত্রী ছিল বলে জানানো হলেও বেঁচে যাওয়াদের ভাষ্যমতে যাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। শেষ রাতের দিকে লঞ্চটি দপদপিয়া পৌঁছে। এ সময় আকস্মিকভাবে লঞ্চটিতে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ঠিক কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত তা নিশ্চিতভাবে ফায়ারসূত্র তাৎক্ষণিকভাবে বলতে না পারলেও যাত্রীদের কারও মতে, ইঞ্জিনরুম, কারও মতে কিচেন রুম আবার কারও মতে, বস্ত্রজাতীয় পণ্য থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে থাকতে পারে। আগুন লাগার পর লঞ্চটি সামনের দিকে যতই এগোচ্ছিল আগুনের লেলিহান শিখা ততই বাড়ছিল। শীতের এই শেষ রাতে মাঝ নদীতে বাতাসের গতিও কম ছিল না।
ঘটনার সময় অধিকাংশ যাত্রী ছিল গভীর নিদ্রায়। আগুনের কারণে যাত্রীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় আহাজারি, আর্তনাদ। এ সময় একযোগে সকল যাত্রীর মাঝে প্রাণ বাঁচানোর প্রাণান্তকর প্রয়াস শুরু হয়ে যায়। অনন্যোপায় হয়ে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়। যারা ঝাঁপ দিতে পারেনি বা সাহস করেনি তাদের অধিকাংশই আগুনে দগ্ধ হয়েছে। লঞ্চটি শেষ পর্যন্ত পুড়ে রীতিমতো কঙ্কালসার হয়েছে। এদিকে, যারা অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দেয় তাদের কেউ কেউ সাঁতরিয়ে কূলে উঠতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ রয়েছে। এদের বেশিরভাগের সলিল সমাধি ঘটে থাকতে পারে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো ধারণা দিয়েছে।
ঘটনার পর স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উদ্ধারকাজ শুরু করেন। তারা একে একে দগ্ধ ও আহতদের উদ্ধার করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠায়। এদের মধ্যে আশঙ্কাজনকদের র্যাবের হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। শুক্রবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্মরণকালের ভয়াবহ এ লঞ্চ অগ্নিকান্ডে অন্তত ৪১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া আহতদের অনেকের শরীরের অধিকাংশ জায়গা দগ্ধ হয়েছে। অতিরিক্ত পুড়ে যাওয়ার কারণে লাশের পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। এদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষা লাগতে পারে চিকিৎসক সূত্র জানিয়েছে। মারাত্মক দগ্ধ অনেকে বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
আগুন লাগা লঞ্চটি পরে ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের দিয়াকুল এলাকার নদীর তীরে ভেড়ানো হয়। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী নিহতদের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। ঘটনা তদন্তে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মোঃ জোহর আলী ও ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মোঃ কামাল উদ্দিন ভুইয়া জানান, ঘটনাস্থল থেকে ৪১ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লঞ্চ কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানান, লঞ্চটি ঢাকা থেকে কয়েকশ’ যাত্রী নিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল। রাতে ইঞ্জিন কক্ষে আগুন লাগে। এ সময় কেবিনের যাত্রীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। লঞ্চটি সদর উপজেলার দিয়াকুল এলাকায় গিয়ে নদীর তীরে নোঙ্গর করে। খবর পেয়ে ঝালকাঠির ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দগ্ধ যাত্রীদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করছেন। এদিকে লঞ্চে আগুনের খবর শুনে বরগুনা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে স্বজনরা ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকায় এসেছেন। তাদের আহাজারিতে এখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। ভোর ৫টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্ধার কাজে নিয়োজিতরা।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে দক্ষিণ জনপদের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলোতে ভিড় থাকে অন্য দিনের তুলনায় বেশি। সাপ্তাহিক ছুটির দুটি দিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে অনেকেই লঞ্চে চড়ে বসেন। তাদের অনেকেই এখন বাড়ি ফিরছেন লাশ হয়ে। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে চারশ’র মতো যাত্রী ছিল। তবে উদ্ধার পাওয়া যাত্রীরা বলছেন, আটশ’ থেকে এক হাজার আরোহী ছিল। লঞ্চের ডেকে পেতে রাখা কার্পেট, যাত্রীদের মালামাল, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য দ্রব্যের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের সময়ে স্বামীসহ ইঞ্জিন কক্ষের কাছাকাছি জায়গায় ছিলেন তাসলিমা বেগম। তিনি বলেন, বিকট শব্দ শুনে কাছে এগোতে হইহুল্লোড়ে পেছনে ফিরতে হয় তাকে। আগের জায়গায় ফিরে এসে দেখেন, তার স্বামী সেখানে নেই। অন্য অনেক যাত্রীর মতো তাসলিমাও লাফিয়ে পড়েন নদীতে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। আমি দেখতে যাচ্ছিলাম, কী হয়েছে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারি নাই। এসে দেখি জামাই নাই। আমি আমার জীবনরক্ষায় নদীতে লাফ দিই।’ লাফিয়ে পড়লেও আগুনের লেলিহান শিখা থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাননি তাসলিমা। দগ্ধ শরীর নিয়ে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার।
সর্বশেষ খবরে জানা যায় – নৌ ট্র্যাজেডির এ ঘটনায় সর্বশেষ ৪১ জন নিহত হয়েছেন এবং দেড় শতাধিক যাত্রী আহত হয়ে ঝালকাঠি-বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে আছেন। শুক্রবার ভোর রাতে ইঞ্জিনরুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে মুহূর্তে লঞ্চটির সকল তলায় ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর ঝালকাঠি আসেন এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি অগ্নিকান্ডের তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এছাড়া এই ঘটনায় নিহত পরিবারকে দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ ও নিহতদের দাফনের জন্য আরও ২৫ হাজার টাকা প্রদানের ঘোষণা দেন। আহত পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করার কথা বলেন। বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ¦ আমির হোসেন আমু সার্বক্ষণিক পরিস্থিতির খোঁজ খবর নিচ্ছেন এবং এই ঘটনায় তিনি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের এই ঘটনায় সহযোগিতা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং নেতা-কর্মীরা বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও খোঁজ খবর নিতে আত্মীয়-স্বজনদের শুকনো খাবার এবং রাতে থাকার ব্যবস্থা করেছেন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কোস্টগার্ডের সহায়তায় নদীতে উদ্ধার অভিযান চালায়। লঞ্চে আগুন লাগার পরে লঞ্চটি ঝালকাঠির লঞ্চঘাট সংলগ্ন দিয়াকুলের অংশে নদীর পাড়ে লাগিয়ে দেয়। এর পূর্বেই অনেক যাত্রী জীবন বাঁচানোর জন্য নদীতে ঝাঁপ দেয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাঁতার কেটে পাড়ে উঠতে পারলেও কিছু যাত্রী নিখোঁজ থাকেন। ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মোঃ জোহর আলী জানান, একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসন ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থলে এসে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে উদ্ধারের সহযোগিতা করেছে। ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মইনুল হক জানান, ঘটনার পরপরই পুলিশ লাশ উদ্ধার ও তাদের চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে এবং সর্বশেষ মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য পৌর মিনিপার্কে রাখা হয়েছে। ঝালকাঠির সিভিল সার্জন ডাঃ রতন কুমার ঢালী জানান, লাশ মর্গে রাখা আছে এবং শনাক্ত করার পরে ময়নাতদন্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য তার বিভাগের চিকিৎসকরা কাজ করছেন।
নিজস্ব সংবাদদাতা মোস্তফা কাদের বরগুনা থেকে জানান, স্মরণকালের ভয়াবহ লঞ্চ অগ্নিকা-ের ঘটনায় বরগুনায় শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। এ দুর্ঘটনার শিকার অধিকাংশ যাত্রীর বাড়ি বরগুনা জেলায়। নিহত সকলের পরিচয় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি। অগ্নিদগ্ধে অনেকেরই চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। মৃতদেহ দেখে কাউকেই শনাক্ত করা যাচ্ছে না। অগ্নিদগ্ধদের পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ টেস্ট লাগতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন। অগ্নিদগ্ধের অনেককেই বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে।