সংসদ অধিবেশনের শুরুতেই উত্তাপ, ওয়াকআউট ॥ বিএনপির হারুনের বিতর্কিত মন্তব্য প্রত্যাহার

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুরুর দিনই বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের একটি বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে কিছু সময়ের জন্য উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংসদ অধিবেশন। ‘বর্তমান সংসদেও অনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রয়েছেন’ এমন মন্তব্য করে সংসদে তোপের মুখে পড়েন বিএনপির এই সংসদ সদস্য। সভাপতির আসনে থাকা স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও এ ধরনের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে তা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। স্পীকারের অনুরোধ এবং সরকারী দলের সংসদ সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে হারুনুর রশীদ তার সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করলেও ‘প্রত্যাহার করতে বলার প্রতিবাদে’ সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন। তবে তার সঙ্গে সংসদে থাকা বিএনপিদলীয় অন্য সদস্যরা ওয়াকআউট করেননি।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার সংসদ অধিবেশন শুরু হলে পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত বক্তব্যের সময় এ সব ঘটনা ঘটে। দুই সপ্তাহ ইউরোপ সফর শেষে রবিবার সকালে দেশে ফিরেই সংসদ অধিবেশনে যোগ দেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ও রুস্তম আলী ফরাজীর পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্যের পর বিএনপির হারুনুর রশীদ ফ্লোর নেন। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, প্রাণহানির ঘটনা তুলে ধরে বলেন, যে এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ ভোট হচ্ছে, সেখানটায় আতঙ্কের এলাকায় পরিণত হয়েছে।
এ পর্যায়ে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে ‘এই সংসদে অনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন হারুনুর রশীদ। সঙ্গে সঙ্গেই সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে মাইক ছাড়াই এমন বিতর্কিত মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন। তীব্র প্রতিবাদ, বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে সংসদ সদস্যদের তীব্র দাবির মুখে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন। স্পীকার এ সময় তার ওই মন্তব্য প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানান। সরকারী দলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তোপের মুখে থাকা বিএনপিদলীয় এই সংসদ সদস্য তার কথাগুলো সম্পন্ন করার সুযোগ দিতে স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
স্পীকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনি প্রত্যাহার করতে বলেছেন। আমি আগে উত্থাপন করি। আপনি যদি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেন, তাহলে অবশ্যই প্রত্যাহার করব।’ এ সময় সরকারী দলের সংসদ সদস্যরা আবারও নিজ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে তীব্রস্বরে প্রতিবাদ জানাতে থাকে, যার কারণে স্পীকার কোন কথা শুনতে পাচ্ছেন না বলে হাউসকে জানান এবং হেডফোন কানে দেন। পরে সকলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে হারুনুর রশীদ তার ওই মন্তব্য প্রত্যাহার করে স্পীকারকে উদ্দেশ করে বলেন, এই সংসদে অনির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছে বলে আমার বক্তব্য আপনি প্রত্যাহার করার অনুরোধ করছেন, আমি প্রত্যাহার করছি।
পরে তিনি স্পীকারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি সংসদের গার্ডিয়ান। আমি আপনার কাছে ব্যাখ্যা চাই- ইতোমধ্যে দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। তৃতীয় ধাপ ও চতুর্থ ধাপের তফসিল হয়েছে। তিন শতাধিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং গোটা পরিষদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের নির্বাচিত বলা হচ্ছে। তারা কাদের দ্বারা ইলেকটেড? এই বিষয়ে আপনার কাছে ব্যাখ্যা চাচ্ছি। আপনি আমাকে (বক্তব্য) প্রত্যাহার করতে বলছেন, কিন্তু আমার প্রশ- তারা কাদের দ্বারা নির্বাচিত? এই বিষয়টি এখানে পরিষ্কার করবেন। সংবিধান যেখানে বলছে, প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
হারুনুর রশীদ আরও বলেন, সম্প্রতি ফ্রান্সে ভোট হয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ভোট হয়েছে। সেখানে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার পরও সেখানকার আইন অনুযায়ী ৫০ শতাংশ ভোট প্রেসিডেন্ট পাননি বলে পুনরায় ভোট হয়েছে। তিনি বলেন, কোন কাজের জন্য যখন টেন্ডার হয়, সেখানে একজন অংশশ্রহণকারী থাকলে পুনরায় টেন্ডার আহ্বান করা হয়। তাহলে যে সব জায়গায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাদের নির্বাচিত করা হচ্ছে, কেন সে সব জায়গায় পুনর্তফসিল করা হচ্ছে না?
এটা একটি বড় রকমের সঙ্কট তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে হারুন বলেন, আজকে নির্বাচনে বিরোধী দল (বিএনপি) অংশগ্রহণ করছে না। যে কারণে সরকারী দল ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীরা সারাদেশে হানাহানি-খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, স্থানীয় নির্বাচনে এটা একটু ঝগড়াঝাটি। ৪০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছে। এরপরও আমরা এটাকে ঝগড়াঝাটি বলব? স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? কেন আপনারা আজকে বলছেন প্রত্যাহার করেন এই কথাটা? যুক্তিসংগত সাংবিধানিক এই জায়গাটি পয়েন্ট অব অর্ডার আকারে আমি উত্থাপন করতে চেয়েছি। কিন্তু আমাকে প্রত্যাহার করতে বলায় সংসদ থেকে ওয়াকআউট করছি। পরে হারুনুর রশীদ একা একা সংসদ কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান।
পরে তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী অনির্ধারিত আলোচনায় ফ্লোর নিয়ে বলেন, উনি (বিএনপির হারুন) আসলে ওয়াকআউট করেছেন ভয়ে। বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলে এমপি হারুন যে দাবি করেছেন, তা মোটেও সত্য নয়, বরং সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার নির্বাচনী এলাকায় আলী আজম নামে এক বিএনপি নেতা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এছাড়া মির্জা ফখরুল নিজেই বলেছেন স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে তার কোন আপত্তি নেই।
১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের এই নেতা আরও বলেন, এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আগামী সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে তারা এই কাজগুলো করছে। সংবিধান রক্ষার্থে নির্বাচন আগেও হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। জাতীয় নির্বাচনে কে আসবে বা কে আসবে না, বিএনপি জামায়াত-শিবিরের দল। তারা নির্বাচনে না এলে কিছু আসে-যায় না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেশে নির্বাচন হবে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করব। দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে। আগামী দিনে বিএনপি-জামায়াতের অস্তিত্ব থাকবে না।
এদিকে হারুনুর রশীদ ওয়াকআউট করলেও বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপি রুমিন ফারহানাসহ অন্যরা সংসদেই ছিলেন। পরে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে রুমিন ফারহানা বলেন, ওয়াকআউট করে সংসদটাকে খালি করে ফেললে বোধহয় সরকারী দলের সদস্যদের সুবিধা হতো। তবে এত বেশি সুবিধা আমরা দেব না। এ সময় তিনি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ৭৫ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কমে গেছে। এমন একটি সরকার বর্তমানে ক্ষমতায়, যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করেন, সেই সময় কেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে? সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোন বিচার করা হয়নি। এরপর স্পীকার আর কাউকে ফ্লোর না দিলে অধিবেশন শান্ত হয়।