কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলমান জলবায়ু সম্মেলনের শেষ দিকে এসে মূল ইস্যুগুলোর ওপর দর কষাকষি শুরু হয়েছে। এজেন্ডা বহির্ভূত তিনটি ইস্যুতে অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত প্রধান ইস্যু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। এই ইস্যুটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি (লস এ্যান্ড ডেমেজ) মোকাবেলায় বড় অগ্রগতি হয়েছে। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে ধনী দেশগুলো। শুধু তাই নয়, ধনী দেশগুলো এখন এর দায় স্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয় ও ক্ষতি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থায়ন করতে চায়। আয়োজক দেশ স্কটল্যান্ড প্রতীকী অর্থ বরাদ্দ দিয়ে এই অর্থায়নের সূত্রপাত করেছে। বড় বড় কয়েকটি দেশও এখানে অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থ পাবে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে চলমান ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনের দর কষাকষি প্রসঙ্গে প্রাপ্ত তথ্যে এসব বিষয় উঠে এসেছে। নেগোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত সূত্রগুলো ঢাকায় এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতির মোকাবেলায় যে সকল দেশ অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে তার মধ্যে এগিয়ে আছে স্বয়ং আয়োজন দেশ স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ড এক ১০ লাখ পাউন্ড (১৪ লাখ মার্কিন ডলার) দিয়ে এই অর্থায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোন দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতি মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে।
জলবায়ু বিশ্লেষকরা এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় হাজার হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন। তার বিপরীতে স্কটল্যান্ডের প্রতিশ্রত অর্থ পরিমাণে কম হলেও ধনী দেশগুলোর জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে। এই দেশটির দেখাদেখি অন্য দেশগুলোও এ খাতে অর্থায়নে এগিয়ে আসবে।
তবে অর্থায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের ভিন্নমত রয়েছে। এই দেশগুলো জাতিসংঘের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্থায়ন করতে চায় না। তারা বহুপাক্ষিক অর্থায়নকারী সংস্থা অথবা দ্বিপাক্ষিকভাবে অর্থায়ন করতে চায়। এ বিষয়ে তারা আলাদা একটি তহবিল গঠন করে সেই তহবিল থেকে অর্থ প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে এখন পর্যন্ত অর্থায়নের প্রক্রিয়ার বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এক্ষেত্রে এডাপটেশন বা অভিযোজনের বিষয়টি জড়িত রয়েছে। এতদিন ধনী দেশগুলো লস এ্যান্ড ডেমেজকে অভিযোজনের মধ্যে রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। তারা বলছিল, লস এ্যান্ড ডেমেজ হচ্ছে এডাপটেশনের একটি অংশ। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এ বিষয়ে বার বার আপত্তি জানিয়ে আসছিল। তারা বলছিল, এটি এডাপটেশনের বাইরের ঝুঁকি। এজন্য আলাদাভাবে তহবিল গঠন করে ক্ষতি মোকাবেলায় অর্থায়ন করতে হবে।
উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষয় ও ক্ষতির ইস্যুটি প্রথম ১৯৯১ সালে সামনে নিয়ে আসে ক্ষুদ্র দ্বীপ ও রাষ্ট্রগুলোর জোট এওএসআইএস। ওই বছর তারা প্রস্তাব করে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতির দায় শিল্পোন্নত দেশগুলোকে ভাগ করে নেয়ার। ২০১২ সালে কাতারের রাজধানী দোহাতে অনুষ্ঠিত ১৮তম জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনার এজেন্ডায় ক্ষয় ও ক্ষতির ইস্যুটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশোতে অনুষ্ঠিত ১৯তম জলবায়ু সম্মেলনে এ বিষয়টি কিভাবে কাজ করবে সে বিষয়ে একটি ম্যাকানিজম গঠন করা হয়, যাকে ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজম বলা হয়। শেষ পর্যন্ত দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর চাপের মুখে এই ইস্যুটি প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ঠাঁই পায়। পরের বছর মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে এটি কার্যকর করা জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে চিলির আয়োজনে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে লস এ্যান্ড ডেমেজের থেকে ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনাল ম্যাকানিজমকে একটি অর্থায়নকারী সংস্থায় পরিণত করার প্রস্তাব করা হয়। এটিকে ‘সান্টিয়াগো নেটওয়ার্ক ফর লস এ্যান্ড ড্যামেজ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে এই প্রস্তাবিত প্রক্রিয়াটিকে অর্থায়নের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করতে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশসমূহ চাপ সৃষ্টি করে আসছে।
জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া পর্যবেক্ষকরা প্রথম সপ্তাহের আলোচনায় লস এ্যান্ড ডেমেজের অগ্রগতিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন। তবে তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, জাতিসংঘের প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে আলাদা তহবিল গঠন করা হলে তা কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার এই তহবিলে অর্থায়ন বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে না। ইচ্ছে হলে কোন দেশ অর্থায়ন করবে না হলে করবে না। আবার কোন দেশ কি পরিমাণ অর্থায়ন করবে সে বিষয়েও কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই তহবিলের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা আছে। প্রথম দিকে কিছু অর্থ দিয়ে হয়তো তহবিল গঠন করে অর্থায়ন শুরু করা হলো। পরবর্তীতে এটি বন্ধ হয়ে গেলে কারও বলার কিছু থাকবে না। তাই এই তহবিলকে জাতিসংঘের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে আসতে হবে এবং যে সকল বিষয় নিয়ে প্রশ্ন আছে সেগুলোকে আগামী কয়েক দিনের আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে।
জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহের আলোচনায় লস এ্যান্ড ডেমেজ ছাড়া আর কোন এজেন্ডায় অগ্রগতি হয়নি। তবে এজেন্ডার বাইরে তিনটি ইস্যুতে বেশ ভালই অগ্রগতি হয়েছে। এগুলো হলো বন সংক্ষণ, জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার কমানো এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে মিথেন গ্যাস কমানো।
জলবায়ু সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনেই শতাধিক বিশ্বনেতা ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে এটিই ছিল প্রথম বড় সমঝোতা। আমাজন বনের বড় অংশ কেটে ফেলা হয়েছে ব্রাজিলে। সেই ব্রাজিলও প্রতিশ্রুতিদানকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। তবে এই তালিকায় নেই বাংলাদেশ ও ভারত। ২ নবেম্বর এ নিয়ে একটি চুক্তিসই হয়। এই বন উজাড় বন্ধে সরকারী-বেসরকারী মিলে বরাদ্দ রয়েছে ১ হাজার ৯২০ কোটি ডলারের তহবিল। পরিবেশ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ২০১৪ সালে ধীরগতিতে বন উজাড় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে বলেও সতর্ক করেছেন।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ধরা হয় কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারকে। কিন্তু এবারের জাতিসংঘ জলবায়ু পরির্বতন বিষয়ক সম্মেলনে অন্তত ১৯০টি দেশ ও সংস্থা কয়লার ব্যবহার বন্ধে রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে এমন সুখবরের মধ্যেই হতাশা ছড়িয়েছে চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে উন্নত দেশগুলো মিথেন গ্যাসের নির্গমন কমানোতে সম্মত হয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ২০৩০ সালের মধ্যে মিথেন গ্যাসের নির্গমন ২০২০ সালের স্তরের চেয়ে ৩০ শতাংশ কমানোর সুস্পষ্ট ঘোষণা দেন। উন্নত দেশগুলো কার্বনের পরিবর্তে এখন মিথেন গ্যাস কমানোর ওপর জোর দিচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য।
মিথেন সবচেয়ে সহজ হাইড্রোকার্বন গ্যাস, যা সরাসরি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। মিথেন গ্যাস যানবাহন, কয়লা উৎপাদন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল থেকে উৎপন্ন হয়। পশুর খামার, ভাগাড় এবং কৃষি পদ্ধতিও প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
এছাড়া জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজটি জোরালো হয়েছে। গত ৫ ও ৬ নবেম্বর যুবক গ্রুপ ও শিশুরা গ্লাসগোর রাস্তায় নেমে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিশেষ করে ৫ নবেম্বর সকাল থেকে গ্লাসগো শহরের বিমানবন্দর এলাকা ও বিভিন্ন সড়কে দল বেঁধে শিশুদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। মূলত পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের দাবিতে শিশুরা এই বিক্ষোভ করে। তাছাড়া ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষ কেলভিংগ্রোভ পার্কে বিক্ষোভ করেছেন। তাদের সঙ্গেও যোগ দেয় শত শত শিশু। গ্লাসগো স্কয়ার ও গ্লাসগো সিটি সেন্টার ও গ্লাসগো কুইং স্টেশনের সামনেও তাদের বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।