কাজিরবাজার ডেস্ক :
ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘটের জের এখনও চলছে। বৃহস্পতিবার রাতে তেলের নতুন দাম ঘোষণার পর সকালেই ঘুম থেকে ওঠে দেশবাসী পরিবহন বঞ্চিত হয়ে যে খেসারত দিয়েছে, তার জের ধরে এখনও চলছে চরম সমালোচনা ও ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। সরকার সমর্থিত দেশের শীর্ষ পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর আচরণ শুধু মানুষকেই বেকায়দায় ফেলেনি- সরকারকেও বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। তেলের দাম কমানোর অজুহাতে তারা হঠাৎ গণপরিবহন বন্ধ করে বিএনপি জামায়াত স্টাইলে দেশ অচল করে দেয়ার তিন দিনের মাথায় তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয় সরকার। রবিবার দিনভর বিআরটিএ কার্যালয়ে তারা তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে অনড় থাকে। শেষ পর্যন্ত বিআরটিএ তথা সরকার বাধ্য হয় তাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে। তাদের দেয়া দাবি মতোই বাস মিনিবাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। কিন্তু বৈঠকে দেশবাসীর প্রধান দাবি তেলের দাম কমানোর বিষয়ে পরিবহন নেতৃবৃন্দ তেমন সোচ্চারও ছিলেন না।
বাসযাত্রী হাসানের মতে- সরকার পরিবহনের কাছে জিম্মি বিধায় তাদের দেয়া সব দাবিই সব সময় মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু জনগণের প্রকৃত ভোগান্তি ও বোঝা তেলের দাম নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথাও নেই। তেলের দাম কমানোর কোন উপায়ও নেই। পরিবহন নেতারাও এ নিয়ে তেমন সোচ্চার ছিলেন না।
উল্লেখ্য, গত শুক্র শনি ও রবিবার রাজধানীসহ দেশজুড়ে বন্ধ ছিল গণপরিবহন। এতে দেশবাসী চরম দুর্দশা ও ভোগাান্তির শিকার হন। বিশেষ করে অনেক বেকার তরুণ-তরুণী নিয়োগ পরীক্ষা দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাদেরই একজন শাহীন বলেন, রাতে ভাল প্রস্তুতি নিয়েও সকালে শুধু পরিবহন না থাকায় নেত্রকোনা থেকে ঢাকায় আসতে পারিনি। রাতে ঘুমানোর সময়ও ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি সকালে বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস পাব না। ফলে যানবাহন না পেয়ে ঢাকায় আসা সম্ভব হয়নি।
শাহীনের দুঃখ এখানেই। রাতেই যদি ঘোষণা দেয়া হতো তাহলেও হয়তো বিকল্প একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখা হতো। পরিবহন সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থে দেশের এত বড় সর্বনাশ করেছে অথচ তা দেখার বা বলার কেউ নেই। উল্টো তাদের কাছে জিম্মি হয়ে তৃতীয় দিনেই সরকার বৈঠকে বসে সব দাবি মেনে নেয়। এতেই জনগণ ও সরকার তাদের কাছে কতটা জিম্মি তা সহজেই অনুমেয়। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, এসব নিয়ে এখন কোন কথা বলতে চাইনা। আজ বুধবার সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে সেখানে সব প্রশ্নের জবাব দেয়া হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশের পরিবহন সেক্টরের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ শ্রমিক পরিবহন ফেডারেশন। এ তিনটি সংগঠনই সরকার সমর্থিত। পরিবহন সংক্রান্ত যে কোন দাবি দাওয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে এ তিনটি সংগঠনই মূল ভূমিকা পালন করে। যে কারণে তাদের অঙ্গুলি নির্দেশেই গোটা দেশের পরিবহন যখন তখন বন্ধ হয়ে যায়- আবার চালু হয়ে যায়। গত শুক্রবার ভোর থেকেই দেশবাসী পরিবহন বঞ্চিত হয়ে যেভাবে তাদের গালমন্দ করেছে তা ছিল নজিরবিহীন। সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাদের পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হলেও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উল্টো বাণী দিয়ে জানিয়েছে, তারা ধর্মঘটের ডাকই দেয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহনের মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ও শ্রমিক ফেডারেশনের শাহজাহান খান সুস্পষ্ট বলেছেন, সংগঠনগুলো ধর্মঘটের ডাক দেয়নি। মালিকরা স্বেচ্ছায় গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের মুখে এমন মন্তব্য শুনে ভুক্তভোগীরাও বিস্মিত। তাহলে তো প্রশ্ন ওঠে- মালিকদের ওপর কি তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের অনুমতি ও সিদ্ধান্ত ব্যতীত কিভাবে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ দেশ অচল করার দুঃসাহস দেখিয়েছে মালিকরা? আবার রবিবার বিকেলে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই সড়কে গাড়ি বের করে মালিকরা। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পরিবহন মালিক সমিতি হঠাৎ গাড়ি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে যে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই এড়ানো যেতো। সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করে যদি দাবি আদায় না করা যেত- তখন সময় নিয়ে কর্মসূচী দিলে মানুষের এত ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতি হতোনা।
যখন তখন এভাবে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়ায় ক্ষুব্ধ বিআরটিএ কর্তৃপক্ষও। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, বাস চলার জন্য রুট পারমিট দেয়া হয় অনেকগুলো শর্ত ও নীতি মেনে। যখন তখন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই এভাবে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়াটা কিছুতেই বৈধ হতে পারেনা। এজন্য নিয়ম কানুন মানতে হয়। হঠাৎ পরিবহন বন্ধ করে জনগণকে এভাবে জিম্মি করে দাবি আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে বিআরটিএ-এর।
এদিকে নতুন ভাড়া আদায় নিয়েও চলছে নৈরাজ্য। যে যেভাবে পারছে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি আদায় করছে। কিলোমিটার অনুযায়ী কেউ ভাড়া নিচ্ছে না। এমনকি সিএনজিচালিত বাসগুলো গত তিনদিন ধরে নতুন ভাড়া আদায় করছে। এমন অভিযোগে দেশের পরিবহন নীতিনির্ধারকরাও ক্ষুব্ধ হয়ে মঙ্গলবার গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে মালিকদের সতর্ক করেছেন। এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়েনি। ফলে তারা আগের ভাড়াই আদায় করবে। কোনভাবেই এসব পরিবহন নতুন ভাড়া আদায় করতে পারবে না। নিয়ম পরিপন্থীভাবে তা করা হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে তিনি সমিতির সকল জেলা শাখা ইউনিটকে জানিয়েছেন। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যেহেতু সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানো হয়নি, সেহেতু তারা নতুন ভাড়া আদায় করতে পারবে না। করলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হবে।
কয়েকটি রুটে বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভাড়া যেন অতিরিক্ত আদায় করা না হয় সেজন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মালিক ও নেতাদের রাস্তায় থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ডিজেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে রবিবার বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে। দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের ভাড়া গড়ে ২৭ শতাংশ ও মহানগর এলাকার বাসভাড়া ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। এরপর ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন বাস মালিকরা। কিন্তু এরপরই পরিবহন কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করছে বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। এমনকি সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যদিও এসব পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাজধানীর মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে অভিযান চালায় বিআরটিএ। অভিযানে এসব অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে।