করোনায় পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি, ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে

3

কাজিরবাজার ডেস্ক :
২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে কোভিড-১৯ এর অস্তিত্ব শনাক্ত হওয়ার দু-এক মাসের মধ্যেই তা বিশ্বের দেশে দেশে ছড়াতে শুরু করে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে প্রাণঘাতি এ করোনাভাইরাসের অভিঘাত আসে বাংলাদেশের ওপর। এসময়ে সংক্রমণ এড়াতে শুরুতেই সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরে করোনা পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় বাড়ে ছুটি। টানা প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি পর্যায়ক্রমে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও ফিরছে প্রাণচাঞ্চল্য।
তবে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ শিশু এবং দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াসহ গোটা এশিয়ায় প্রায় ৮০ কোটি শিশুর পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) ইউনিসেফ ও ইউনেসকো প্রকাশিত এশিয়ায় শিক্ষাখাতের ওপর ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও মোকাবিলা কার্যক্রম বিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ (সিটএন রিপোর্ট) শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ইউনিসেফের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, শিশুদের পড়াশোনার ওপর মহামারির অব্যাহত প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের নেওয়া কর্মসূচি ও উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হয়েছে। যখন সাধারণত শিশুদের বার্ষিক ছুটি থেকে স্কুলে ফেরার কথা, সে সময়ে এ প্রতিবেদনে নিরাপদ হওয়া মাত্রই স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার জন্য সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কিছু দেশে, যেমন ফিলিপাইনে, মহামারিকালে স্কুলগুলো বন্ধ রাখা হয়, যা এখনো বহাল আছে এবং সে কারণে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের দুই কোটি ৭০ লাখ শিক্ষার্থী সশরীরে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজ খোলার আগ পর্যন্ত মহামারির পুরোটা সময় এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
এমনকি বর্তমান সময়ে, যখন পৃথিবী ২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে প্রবেশ করেছে, তখনো এই অঞ্চলজুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ার কারণে দ্বিতীয় বছরের মতো স্কুল বন্ধ থাকছে। এভাবে ক্রমাগত স্কুল বন্ধ থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর, যার মধ্যে রয়েছে পড়াশোনার ক্ষতি; মানসিক দুর্দশা; স্কুলের খাবার ও নিয়মিত টিকা না পাওয়া; কাঠামোগত শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি; এবং শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি। এ ভয়াবহ পরিণতিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এরইমধ্যে অসংখ্য শিশুকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং অনেকগুলো আগামী বছরগুলোতে অনুভূত হবে।
পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইউনিসেফের পরিচালক মার্কোলুইজি কোরসি এ বিষয়ে বলেন, শিক্ষা সেবার ব্যাঘাত শিশুদের ওপর, বিশেষত সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের ওপর যে প্রভাব ফেলেছে তা আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। যখন স্কুল বন্ধ থাকে, তখন শিশুরা শেখার ও বেড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় সুযোগটি হারায়। পুরো একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে বিদ্যালয়গুলো ফের চালুর বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অন্যথায়, পড়াশোনার এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।
যদিও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের পদক্ষেপ নিচ্ছে, ইউনিসেফের সহায়তায় ক্যাম্পেইন ফর পপুলার অ্যাডুকেশন (সিএএমপিই) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মহামারির কারণে স্কুল বন্ধ থাকাকালীন প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর মধ্যে দু’জনের কাছে দূরশিক্ষণ সেবা পৌঁছানো যায়নি। বস্তুগত সম্পদ এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে সহায়তার অভাব ছাড়াও এ কঠিন সময়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশু এবং অনেক কন্যাশিশুর দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণে উল্লেখযোগ্য আরও যেসব বিষয় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের অভাব, গৃহস্থালির কাজের চাপ বেড়ে যাওয়া এবং বাড়ির বাইরে কাজ করতে বাধ্য হওয়া।
এসব কারণেই শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে সব শিশুর কাছে প্রয়োজনীয় সমতাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক দূরশিক্ষণ সেবা পৌঁছানোর ওপর প্রতিবেদনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে শিক্ষার বর্তমান নিম্ন হারের বিষয়টির সমাধান ও শিক্ষার বিভাজন কমানোর জন্য সাহায্য করতে এবং শিক্ষা তহবিল রক্ষা ও সংরক্ষণে শিক্ষা এবং শিক্ষকদের জন্য সহায়তা জোরদারে প্রতিবেদনে সরকার ও অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি মি. শেলডন ইয়েট বলেন, ১৮ মাস বন্ধ রাখার পর বাংলাদেশে এখন যখন স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, তখন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ রেখে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিশুদের সাহায্যার্থে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ায় আমাদের প্রচেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখা উচিত নয়। শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে এবং ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে বিনিয়োগের এখনই সময়।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) হিসাব অনুযায়ী, সংকট কাটিয়ে উঠতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এশিয়া অঞ্চলে ১ দশমিক ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, যা এ অঞ্চলে ২০২০ সালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫.৪ শতাংশের সমান। বিদ্যমান তথ্য-প্রমাণ বলছে, একটি সংকটের মুহূর্তে পড়াশোনার ক্ষতি সামাল দিতে শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া হলে তা অনেক সাশ্রয়ী ও কার্যকর হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিকে সহায়তা করবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেছেন, সরকার, অংশীদার এবং বেসরকারি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু সঠিক কৌশল এবং সঠিক মাত্রায় বিনিয়োগ পাওয়ার জন্যই নয়, বরং স্কুল খোলা বা বন্ধ যা-ই থাকুক না কেন, সব শিশুর জন্য একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে শিক্ষার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সক্ষম আরও টেকসই, কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।
মহামারির কারণে স্কুল থেকে শিশুদের, বিশেষত কন্যাশিশু এবং দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের ঝরে পড়ার বর্ধিত ঝুঁকি সাম্প্রতিক দশকগুলোতে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অর্জিত অগ্রগতিকে উল্টে দিতে পারে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া যদি আগামী নয় বছরে জাতিসংঘের ২০৩০ সালের এজেন্ডার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার শিক্ষাবিষয়ক লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, তবে এ ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা বাজেট গড়ে ১০ শতাংশ বাড়াতে হবে।
ইউনেস্কো ব্যাংককের পরিচালক শিগেরু আয়োগি বলেন, স্কুলে ফেরা শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বড় ধরনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, এশিয়ার ১২ কোটি ৮০ লাখ শিশু মহামারি শুরুর আগে থেকেই স্কুলের বাইরে ছিল, যা বিশ্বব্যাপী স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এটি শিক্ষাজনিত একটি সংকট, যা নিরসন করা প্রয়োজন।
মহামারি শুরুর পর থেকে শিশুদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখা এবং স্কুলগুলো নিরাপদে ফের চালু ও পরিচালনা নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো জাতীয় সরকারগুলোকে সহায়তা দিচ্ছে। গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর অ্যাডুকেশনের (জিপিই) আর্থিক সহায়তার জন্য ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানায়, এ সহায়তা ছাড়া সিটএন রিপোর্ট সম্ভব হতো না।