রায়হান হত্যার এক বছর, বিচারের আশায় ঘুরছেন মা-স্ত্রী-সন্তান

4

স্টাফ রিপোর্টার :
নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশী নির্যাতনে রায়হান আহমদের মৃত্যুর এক বছর গতকাল সোমবার পূর্ণ হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের একবছর পেরিয়ে গেলেও এখনো শুরু হয়নি বিচার কাজ। করোনা সংক্রমণের কারণে মামলার কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে ধীর গতি। এই ঘটনায় দায়ের করা পুলিশের বিভাগীয় মামলার তদন্তও শেষ হয়নি গত বছরেও।
মামলা আর তদন্ত কার্যক্রমে এই ধীরগতিতে হতাশা দেখা দিয়েছে রায়ানের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও। বিচারের দাবিতে এখনও রাস্তায় ঘুরছেন তারা। এক বছর পূর্তির আগেরদিন গত রবিবার বিকেলে রায়হানের মা ও স্ত্রী এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে একটি মানববন্ধনে অংশ নেন। এসময় রায়হানের দেড় বছর বয়সী শিশুকন্যা আলফাকেও নিয়ে আসেন তারা। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এই মানববন্ধনে অংশ নিয়ে রায়হান হত্যার বিচার কাজ দুত সম্পন্নের দাবি জানান রায়হানের মা সালমা বেগম ও স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। নগরীর আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদ (৩৩) কে গত বছরের ১০ অক্টোবর রাতে তুলে নিয়ে আসে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। সেখানে তাকে রাতভর নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। পরদিন ১১ অক্টোবর সকালে মারা যান রায়হান। রায়হান সিলেট নগরের স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় এক চিকিৎসকের চেম্বারে সহকারি হিসেবে কাজ করতেন। রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা প্রথমে ‘ছিতনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যু’ বলে প্রচার করে পুলিশ। তবে রায়হানের পরিবার প্রথম থেকেই নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ করা হচ্ছে। সিলেট মহানগর পুলিশের প্রাথমিক তদন্তেও নির্যাতনের প্রমাণ মিলেছে। এ ঘটনায় ১২ অক্টোবর পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রীর তান্নি বাদি হয়ে সিলেট কতোয়ালি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
গত ৫ মে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ৫ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র প্রদান করে। সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত এই অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেন। তবে এখনও বিচারকাজ শুরু হয়নি।
এদিকে, মামলার পর মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়।
তদন্ত কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর কনস্টেবল হারুনসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। তবে প্রধান অভিযুক্ত আকবর ১৩ অক্টোবর পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। গত বছরের ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একবছরেও শেষ হয়নি বিভাগীয় মামলার তদন্ত
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পরপরই আকবরসহ পাঁচ পুলিশ ও সিলেট কোতোয়ালি থানায় মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবদুল বাতেনসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে ৯টি বিভাগীয় মামলা হয়। এ মামলার তদন্ত একবচরেও শেষ হয়নি। বছর গড়িয়েছে। বিভাগীয় মামলা চলা ৯ পুলিশ সদস্যের মধ্যে ৫ জন রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। এসআই আবদুল বাতেন, এএসআই কুতুব আলী ও দুজন কনস্টেবল সাময়িক বরখাস্ত আদেশে মহানগর পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত আছেন।
বিভাগীয় মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিআরবি (পুলিশ আইন) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কাজে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু-গুরু) বিধান আছে। গুরুত্বদন্ডের আওতায় চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত। লঘুদন্ডে শুধু দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার বা পদাবনতি। বিভাগীয় মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে শুধু আকবর গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যের মধ্যে চলতি মাসে শুধু আকবরের বিষয়ে তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। আরও বাকি চারজনের তদন্ত চলতি মাসের মধ্যেই শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ব্যাপারে রোববার জানতে চাইলে সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ বলেন, পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কার্যক্রম ফৌজাদারি মামলার মধ্যে নেই। এর মাধ্যমে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্ত করা হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আসছে, সেগুলো বিশ্লেষণ ও তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পুলিশ ও সাধারণ মানুষও রয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্যও নেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন পুলিশ বিভাগেই পাঠানো হবে। পরে বিভাগীয় আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি দেওয়া হবে।
মামলার পরবর্তী তারিখ ২ নভেম্বর
ঘটনার সাত মাসের মাথায় গত ৫ মে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়। অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই (সাময়িক বরখাস্ত) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করা হয়। অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন এএসআই আশেক এলাহী, কনস্টেবল হারুন অর রশিদ, টিটু চন্দ্র দাস, ফাঁড়ির টুআইসি পদে থাকা সাময়িক বরখাস্ত এসআই মো. হাসান উদ্দিন ও এসআই আকবরের ‘বন্ধু’ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সংবাদকর্মী আবদুল্লাহ আল নোমান (৩২)।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে চার মাস পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। এরপর অভিযোগপত্র গঠনের শুনানির জন্য আদালত আগামী ২ নভেম্বর তারিখ ধার্য করেন। ওই দিন মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত একমাত্র আসামি আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আগামী ২ নভেম্বর মামলার ধার্য তারিখে পলাতক আসামির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করার বিষয়টি উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) সৈয়দ শামীম আহমদ। তিনি বলেন, অভিযোগপত্র দাখিল করার পর স্বাভাবিকভাবে এত দিনে বিচার কার্য শুরু হতো। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে বিলম্বিত হয়েছে।
শঙ্কিত পরিবার
রায়হান হত্যার বছর পূর্ণ হবার আগেরদিন রাস্তায় নেমে বিচারকাযে বিলম্ব হওয়ার জন্য হতাশা প্রকাশ করেছন তার মা সালমা বেগম ও স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি এবং পরিবারের সদস্যরা। সেই সঙ্গে খুনিদের ফাঁসি দাবি করেছেন তারা। গত রবিবার নগরীর চৌহাট্টাস্থ শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন সালমা বেগম ও তাহমিনা আক্তার তান্নিসহ রায়হানের পরিবারের সদস্যরা।
মানববন্ধনে বক্তৃতাকালে রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও মামলার চার্জশিট দিতে অনেকে দেরি হয়েছে। এতে আমরা কিছুটা হতাশ। প্রয়োজনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা হস্তান্তর করে মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা হোক এবং আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হোক।
মানববন্ধনে উপস্থিত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বলেন, আমার স্বামীর খুনিদের সহায়তাকারী নোমান এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। সে যে দেশেই থাকুক না কেন, তাকে সে দেশের প্রশাসনের সহায়তায় দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক।