কন্যাশিশু অভিশাপ নয়! আশির্বাদ

34

ওবায়দুল মুন্সী :

সন্তানের জন্ম নিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি সংস্কৃতিরই একটি নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। এই সংস্কৃতি নানা দেশে নানা রকম। জানা যায়, ভারতের রাজস্থানের পিপলান্ত্রি গ্রামে সন্তানের জন্মদিন পালন করা হয় অভিনব উপায়ে। নবজাতকের জন্য কোনো উপহার না এনে,তাঁরা নবজাতকে স্বাগত জানায় ১১১টি গাছ লাগিয়ে। এবং এই বৃক্ষরোপণ উদযাপন করা হয় শুধু মেয়ে শিশুর জন্ম উপলক্ষে। প্রতিবার পিপলান্ত্রি গ্রামে একজন মেয়ে জন্মগ্রহণ করে, তার সম্মানে ১১১টি চারা গাছ লাগানো হয়!
বিস্ময়কর এই উদ্যোগটি নিয়মিত এক রীতিতে পরিণত করেন এখানকার একজন গ্রাম প্রধান যাঁর নাম শ্যামসুন্দর পিলাউলি। তার কন্যাসন্তান তরুণ বয়সেই মারা যান। মৃত সন্তানের স্মৃতি রক্ষার পরিকল্পনা থেকেই তিনি এই প্রথা চালু করেন গ্রাম জুড়ে। পিপলান্ত্রি’তে এখন আর গ্রাম প্রধান নেই, কিন্তু তার কীর্তি আছে। তার চালু করা উদ্যোগটি এখন পুরো গ্রামের এক লঙ্ঘনীয় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
১১১টি গাছ আর মেয়েটি একইসঙ্গে বড় হতে থাকে। এই মেয়ে কখনই আর তার বাবা-মায়ের জন্য বোঝা হিসেবে গণ্য হয় না। গ্রামবাসীরা প্রত্যেকেই গাছগুলিকে পরম যত্নে বড় করেন। মেয়ে শিশুর নিরাপত্তা আর বেড়ে ওঠার পরিবেশের উন্নতির জন্য এই উদ্যোগ তুলনাহীন।
একসময় ভারতের অন্য অঞ্চলের মতো এই গ্রামেও, কন্যা শিশুর জন্মকে আর্শীবাদ নয় বরং অভিশাপ হিসেবেই দেখা হত। মেয়ে মানে পরিবারের বোঝা। যৌতুক ছাড়া মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে না। আর যৌতুকের টাকা যোগাড় করা সব বাবা-মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়! আদিকাল থেকেই ছেলেশিশুর থেকে মেয়েশিশুকে দুর্বল করে দেখা হতো। তাই ১৮ বছরের আগেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে অধিকাংশ পরিবার। মেয়েরা কখনই পুরো শিক্ষার আলো পায় না। মেয়েদের প্রতি অবহেলা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে এখনও প্রকট।
একটি ওয়াজ মাহফিলে শুনেছি, কন্যাশিশু ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য বেহেশতের শুভসংবাদ বয়ে আনে এবং সংসার জীবনকে মায়া-মমতায় ভরে রাখে। এরা ঘরের সৌন্দর্য, ঘরকে আলোময় করে তোলে। কিন্তু বর্তমান সমাজে অনেকেই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে খুবই বিব্রতবোধ করেন। একাধিক কন্যা হলে অত্যন্ত হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কেউ কেউ কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে বিভিন্ন রকম অমানুষিক নির্যাতন করে থাকে। এমনকি তালাক দেওয়ার মতো নির্মম ও অত্যন্ত জঘন্য কাজও করে থাকেন। নির্মম সত্য হলো, এখনো আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি বিশ্ব ব্যবস্থায় বিরাজমান বাস্তবতা কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষার পক্ষে মোটেই অনুকূলে নয়। অথচ কন্যাসন্তান প্রতিপালনে রাসূলুল্লাহ (সা.) উদাত্তকণ্ঠে আহবান জানিয়েছেন। অসংখ্য হাদিসে কন্যাশিশু প্রতিপালনের মর্যাদা ও অশেষ পুণ্যের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। মহানবী (সা.) পিতার অন্তরে কন্যাসন্তানের প্রতি গভীর মমত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তানকে বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, কিয়ামতের দিন আমি ও সে এরূপ কাছাকাছি থাকব বলে তাঁর আঙুলগুলো মিলিয়ে দেখান। (মুসলিম)।
পুত্র কিংবা কন্যাকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সমান অধিকার ও সুযোগ পেলে কন্যারাও সমাজে নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। ইসলাম মানুষকে এ ধারণায় দীক্ষিত করেছে যে, পুত্র- কন্যা দুই ধরনের সন্তানই মহান আল্লাহর বিশেষ উপহার।
সন্তানকে চোখ জুড়ানো সম্পদ বিবেচনা করে পুত্র বা কন্যা হোক আচরণের ক্ষেত্রে এ দুইয়ের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করে না। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে সাধারণত পুত্রসন্তানের প্রতি অধিক যত্ন নেওয়া হয়। বৃহত্তর সমাজ তো দূরের কথা, পরিবারেই কন্যাশিশুটি সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়। এটি আমাদের জরাজীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার মারাত্মক ত্রুটি। ইসলামের সুমহান বাণী তাদের বোধ-বিশ্বাসে সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান করে নিতে পারেনি। অথচ মহানবী (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, তোমাদের সন্তানদের মধ্যে কন্যাই উত্তম। (মুসলিম)। দরিদ্র পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে কন্যার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ছেলের লেখাপড়া কষ্টে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ কিশোরীটিও যে পরিবারে শ্রম ও মেধা দিয়ে সাহায্য করে, তার হিসেব কেউ রাখে না। তারা মেধাবী নয়, সৃষ্টিশীল নয়, এমন অজুহাতে অনেক সময়ই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরিবার তাদের প্রাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। সংসারে মেয়েদের কাজকে স্বীকৃতি দেয়া হয় না। তার কাজের যে আর্থিকমূল্য আছে তা বিবেচনায় নেয়া হয় না।
কন্যাশিশুকে তার সমবয়সী একজন পুত্রসন্তানের মতো একইভাবে আদর-যত্ন দিয়ে লালন-পালনের প্রতি সব মা- বাবারই আরো সচেষ্ট ও সচেতন হতে হবে; তা না হলে এর প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর পড়বে। তাই কন্যাশিশুর প্রতি কোনো রকম তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, পুত্র ও কন্যার মধ্যে পার্থক্য বিধান এবং মেয়েদের ওপর ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্য দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন নবী করিম (সা.)। আমাদের সমাজব্যবস্থায় মনে করা হয়, বিয়েই হচ্ছে কন্যাশিশুদের একমাত্র গন্তব্যস্থল। তাই প্রয়োজনে শিক্ষাকে ব্যাহত করেও নির্দিষ্ট বয়সের আগেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। আর্থিক কারণে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হলে কন্যাশিশুর ভাগ্যেই তা জোটে। এখনো অনেক পরিবারে কন্যাশিশুকে প্রয়োজনীয় বা ছেলে শিশুর আনুপাতিক হারে খাবার খেতে দেওয়া হয় না। কন্যাশিশুর অসুস্থাতাকেও অনেক পরিবারে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ছোটবেলা টিভির একটি বিজ্ঞাপনে দেখতাম, খাবারের উৎকৃষ্ট অংশ, যেমন মাছের বড় মাথাটা, কন্যাকে না দিয়ে পুত্রকে দেওয়া হতো। অথচ কিশোরীর স্বাস্থ্য ভাল রাখতে হলে সঠিক ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রয়োজন। খাবারদাবার সম্পর্কিত কুসংস্কার দূর করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত নীতিকথা আর চিন্তাচেতনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি অনেকেই। মহানবী (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) এর সঙ্গে যে ধরনের উঁচুমানের ব্যবহার করতেন, তা ছিল তৎকালীন সমাজের নিয়মকানুনবহির্ভূত। তিনি কন্যাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, যেখানে যেতেন শিশু ফাতেমাকে সঙ্গে নিয়ে বলতেন তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার প্রথম সন্তান মেয়ে।
আজকের কন্যাশিশুই আগামী দিনের একজন নারী, আগামী দিনের মা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়ামক শক্তি। অথচ বঞ্চনার কারণে কন্যাশিশুরা পরিণত বয়সে ছেলেদের মতো মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারছে না। এভাবে কন্যাশিশুকে অধিকারবঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যের সূত্রপাত হয় তার খেসারত শুধু কন্যাশিশু আর নারী নয়, গোটা জাতিকে দিতে হয়। এ কঠিন বাস্তবতায় ইসলামে কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষা ও বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়া প্রয়োজন।
কন্যাশিশুর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য, অবহেলা, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এখনই। এজন্য সরকার ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে শিক্ষাভাতা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনাবেতনে অধ্যয়ন সুবিধা, বিধবাভাতা, বয়স্কভাতা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নারী অধিকার রক্ষা ও নারীর প্রতি সহিংসতারোধে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কর্মসূচিগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে এদেশে কন্যাশিশুর অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।