বিভক্ত ভ্যাকসিন পৃথিবী

3

সাব্বির খান :

কোভিড-১৯-এর তৃতীয় তরঙ্গ আফ্রিকা ও এশিয়ায় পুরোদমে চলছে, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে কমসংখ্যক মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে যেতে পারে করোনা মহামারি। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে ‘দুর্যোগকালীন প্রেসক্রিপশন’ বলে অভিহিত করেছেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার প্রখ্যাত মহামারি বিশেষজ্ঞ লোন সাইমনসেন। বিশ্বের ইকোসিস্টেম, মনুষ্য অবকাঠামো ও বিশ্ব সমাজব্যবস্থা করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। করোনা পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়েছে যে প্রতিটি দেশের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু ভাবাই যায় না।
উগান্ডার চার কোটি ৪০ লাখ জনগণের ৪১ শতাংশ চরম দারিদ্র্যে বাস করে। করোনার কারণে যখন সমাজ ও জীবন স্থবির হয়ে গেছে, তখন তাদের বাঁচা-মরার প্রশ্নটি আরো অধঃপতিত হয়েছে। সে দেশে পাঁচ সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের কারণে অনেকের চুলা জ্বলেনি এবং খাদ্য ক্রয়ের সমর্থ ছিল না। করোনায় দুই হাজার ৪০০ জনের মৃত্যু এবং প্রায় ৯০ হাজার জন সংক্রমিত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে দেশটি। তবে সংক্রমণের ক্রমোবৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক এ কারণে যে অদ্যাবধি দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ০.১ শতাংশ পূর্ণ টিকা গ্রহণ করতে পেরেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটিই মাত্র উপায় ‘টিকা’। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশই অদ্যাবধি ভ্যাকসিন উৎপাদক সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে সমর্থ হয়নি। পাশাপাশি বিশ্বের ধনী দেশের বেশির ভাগই ভ্যাকসিন কিনে গুদামজাত করেছে। বিশ্বে উগান্ডার মতো অনেক দেশই ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার করছে। উন্নত দেশের তুলনায় অনুন্নত দেশগুলোর টিকা না পাওয়ার হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি, যা পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে।
ডেনমার্ক ও যুক্তরাজ্যে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট খুব কম সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে তুলনায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কিভাবে এর প্রভাব ফেলবে তা কল্পনা করাও কঠিন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে ‘ভ্যাকসিন’। সে জন্য এগিয়ে আসতে হবে ধনী দেশগুলোকে, তাদের হতে হবে আরো উদার ও সুবিচারক। মহাদেশভেদে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা হলো ইউরোপে ৩৫ ও ১১ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ৩৬ ও ৯.৫ শতাংশ, দক্ষিণ আমেরিকায় ১৭ ও ২২ শতাংশ, এশিয়ায় ৯.৭ ও ১৭ শতাংশ, মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৮.৫ ও ১২ শতাংশ, সর্বশেষ আফ্রিকায় ১.৫ ও ১.৬ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আফ্রিকাই হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা মহাদেশ, যারা সবচেয়ে কম ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ বিশাল এই মহাদেশের সর্বমোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ টিকার দুটি ডোজ গ্রহণে সক্ষম হয়েছে, যা ইউরোপের (৩৫ শতাংশ) তুলনায় খুবই নগণ্য। টিকাদান কর্মসূচিতে আফ্রিকার চেয়ে এশিয়া কিছুটা এগিয়ে থাকলেও মাত্র ১০ শতাংশেরও কম মানুষ পূর্ণ ডোজ পেয়েছে। এশীয় দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যানের মধ্যে দেখা যায় অসমতা। যেমন ইসরায়েলে ৬০ শতাংশের বেশি জনগণ পূর্ণ টিকা পেলেও ইন্দোনেশিয়ায় এই সংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ।
সুইডেনের ভাইরোলজিস্ট নিক্লাস আর্নবার্গের মতে, ‘যখন সংক্রমণ বিস্তারের প্রবণতার মাত্রা ভয়ানক হয় এবং তা প্রতিরোধে খুব অল্পসংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, তখন ভাইরাসের রূপ পরিবর্তন (মিউটেড) হয়ে নতুন ভেরিয়েন্টের জন্ম দেয়, যা সংক্রমণকে আরো অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।’ অর্থাৎ আফ্রিকা ও এশিয়ায় বর্তমানে যা ঘটছে, তা নিক্লাস আর্নবার্গের উক্তিরই প্রতিফলন বললে অত্যুক্তি করা হবে না। বিশ্বে করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে গবেষকরা প্রতিনিয়তই নতুন নতুন করোনা ভেরিয়েন্টের দুঃস্বপ্নে দিনাতিপাত করছেন। ভাইরোলজির তত্ত্বীয় সূত্রানুসারে, ‘যখন কোনো সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বিস্তৃতি লাভ করে, তখন বিদ্যমান ভ্যাকসিনের ইতিবাচক দিকটির চেয়ে নেতিবাচক দিকটিই বেশি কাজ করে এবং ভাইরাস মিউটেশনের ঝুঁকি তখন অধিকাংশে বেড়ে যায়।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত মোট ১.৪ বিলিয়ন করোনা ভ্যাকসিন ডোজ ক্রয় বা মজুদ করেছে, যার মধ্যে প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ডোজ আমেরিকানরা গ্রহণ করেছে। চাহিদার স্বল্পতা ও ভ্যাকসিনের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ অব্যবহৃত ডোজ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বোস্টনের দ্য স্টেটের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আইনি জটিলতা ও লজিস্টিক অপ্রতুলতার কারণে অব্যবহৃত ডোজগুলো অন্য দেশকে দিয়ে দেওয়ার সুযোগও সীমিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এরই মধ্যে মোট ৪.৪ বিলিয়ন ডোজ মজুদ করেছে, যা ইইউ নাগরিকদের প্রতিজনকে মোট পাঁচটি করে ডোজ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক ডকুমেন্ট থেকে জানা যায়, দরিদ্র দেশগুলোতে তারা মোট ১৬০ মিলিয়ন ডোজ অনুদান হিসেবে পাঠাবে, যা তাদের মোট সংগৃহীত ডোজের তুলনায় মাত্র ৩ শতাংশ। জরিপ সংস্থা এয়ারফিনিটির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে প্রস্তুতকৃত সব ভ্যাকসিন এরই মধ্যে ধনী দেশগুলো ক্রয় করে ফেলেছে।
ন্যায়-অন্যায়ের বিচারে নয়, বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিবেচনায় প্রবণতাটি নিঃসন্দেহে বোকামি। পেন্ডামিকে যে দেশগুলোর সবচেয়ে বেশি টিকার প্রয়োজন, সচ্ছল দেশগুলোর উচিত তাদের সে পরিমাণ টিকার জোগান দেওয়া। প্রক্রিয়াটিকে ‘দান’ হিসেবে না দেখে বরং নিজেদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা উচিত। বিশ্বের ভ্যাকসিন-ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) কর্তৃক পরিচালিত কোভ্যাক্স ও গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স-গাভির যৌথ উদ্যোগে যে কাজ শুরু হয়েছে তা দৃষ্টান্তমূলক। কোভ্যাক্স বিশ্বের সব দেশে কভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সুষ্ঠু বিতরণের জন্য কাজ করছে। ২০২১ সালের মধ্যে কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই বিলিয়ন ডোজ বিতরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যা শুধু উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী ছাড়াও স্বাস্থ্য সেবাদানকারী পেশাদারদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। তবে এ পর্যন্ত মোট ১৩৪টি দেশে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডোজের মতো বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। ধনী দেশগুলোর উদ্বৃত্ত ডোজ অনুদান হিসেবে গ্রহণ করে দরিদ্র দেশগুলোকে বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করাই কোভ্যাক্সের উদ্দেশ্য। জরিপ সংস্থা এয়ারফিনিটির এক পূর্বাভাসে দেখা যায়, কোভ্যাক্স ২০২১ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করতে পারবে। তবে ধনী দেশগুলো তাদের উদ্বৃত্ত ডোজ অনুদান হিসেবে দেয় কি না সে সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে কোভ্যাক্সের ভূতভবিষ্যৎ। কোভ্যাক্সের ধীরগতির কারণ ডোজের অপ্রতুলতা নয়, বরং ধনী দেশগুলোর অনুদান দেওয়ার অনিচ্ছাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। তবে ধনীদের বুঝতে হবে, দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে অনুদান দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. যারা দরিদ্র-দুর্বল, তাদের মানবিক সুরক্ষা দেওয়া এবং দুই. নতুন ভাইরাসের ভেরিয়েন্টগুলো থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা। ভুলে গেলে চলবে না যে বর্ডারে দেয়াল তুলে করোনা থেকে দেশের জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া যাবে না। অন্যান্য দেশকে করোনামুক্ত রাখতে না পারলে নিজ দেশকে করোনামুক্ত রাখা যাবে না।
আফ্রিকা ও এশীয় দেশগুলোর পরিস্থিতি একদিকে যেমন ভয়াবহ দেখাচ্ছে, তেমনি পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য প্রচুর কাজও চলছে। ইউনিসেফ, ডাব্লিউএইচও ও গাভির মতো বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ভ্যাকসিন বিতরণ তথা দেশগুলোতে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ফাইজার ও বায়োএনটেকের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় কভিড ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করবে তারা। প্রতিবছর ১০০ মিলিয়ন ডোজ প্রস্তুত করবে শুধু আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য। চীনা ভ্যাকসিন বর্তমানে ডাব্লিউএইচও দ্বারা অনুমোদিত। গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর হাত থেকে এই ভ্যাকসিন রক্ষা করে বলেও প্রমাণিত।
পৃথিবীটা আজ দুই ভাগে বিভক্ত যাদের ভ্যাকসিন রয়েছে ও যাদের নেই। অর্থনীতির সরলাঙ্কের একটি সরু দাগ যেন বিভক্তি রেখাটি এঁকে দিয়েছে ‘সক্ষম’ আর ‘অক্ষম’-এর মাঝে। নব্বইয়ের দশকের শেষে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের যে শীতল যুদ্ধের অবসান হয়েছিল, তার উত্থান যেন আজ খালি চোখেই আবার সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এ যুদ্ধের নৈতিক দ্বন্দ্বটাও সেই পুরনো কালের ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, যার বাড়ন্ত চক্রবৃদ্ধি হার কারো দৃষ্টি এড়াচ্ছে না!