শিক্ষিত তরুণীরাও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদে ॥ রিমান্ডে নাবিলার চাঞ্চল্যকর তথ্য

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শিক্ষিত তরুণীরাও জঙ্গিবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রায় দেড় শতাধিক আইডির মাধ্যমে ২০-৩০ জন তরুণী জঙ্গিবাদের আদর্শে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর এসব আইডি প্রতিনিয়ত মনিটরিং করে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশের একাধিক সংস্থা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে দেশে প্রথমবারের মতো প্রশিক্ষিত জোবাইদা সিদ্দিকা নাবিলা (১৯) নামে তরুণী জঙ্গিকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গ্রেফতারকৃত নাবিলা ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে বলে সোমবার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। তৃতীয়দিনের জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গি হওয়া ও জঙ্গিবাদের প্রচারের সঙ্গে তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে বলে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। মামলা তদন্ত সহায়ক টিমের প্রধান সিটিটিসির সিটি এ্যান্ড এনালাইসিস ডিভিশনের উপপুলিশ কমিশনার মিশুক চাকমা জানান, প্রশিক্ষিত শিক্ষিত তরুণী জোবায়দা ফেসবুক, টেলিগ্রাম ও ‘চার্পওয়্যার’ নামের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ছদ্মনামে একাধিক এ্যাকাউন্ট খোলেন। প্রাথমিক তদন্তে গ্রেফতারকৃত জোবায়দা টেলিগ্রামে তার চারটি এ্যাকাউন্ট এবং সেই টেলিগ্রাম এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৭টির বেশি চ্যানেল চালাত। এসব চ্যানেলে সে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন উগ্রবাদী সহিংস ভিডিও, অডিও, ছবি ও ফাইল শেয়ার করত। তার সব টেলিগ্রাম চ্যানেল মিলে আনুমানিক ২৫ হাজার সাবস্ক্রাইবার আছেন। যারা নিয়মিত তার চ্যানেলগুলো অনুসরণ করেন। তার দুটি ফেক ফেসবুক এ্যাকাউন্ট, একটি ‘চার্পওয়্যার এ্যাকাউন্টে তথ্য পাওয়া গেছে। ফেসবুকে ফেক এ্যাকাউন্ট থেকে ব্যাপকভাবে আনসার আল ইসলামের উগ্রবাদী সহিংস মতাদর্শ প্রচার, বিভিন্ন উগ্রবাদী প্রচারকারী আইডির সঙ্গে যোগাযোগ ও বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলাচনা করতেন। তিনি জানান, জঙ্গিগোষ্ঠী শতাধিক ওপর আইডির মাধ্যমে তরুণ-তরুণী জঙ্গিবাদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা জঙ্গি আদর্শে বেশি উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এর আগে অনলাইনে জঙ্গি প্রচার চালাতে গিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে সিটিটিসি। এদের মধ্যে অধিকাংশ তরুণ। সূত্রগুলো জানায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করার চেষ্টায় অনলাইনের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে সক্রিয় থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে এখন জঙ্গি সংগঠনগুলো শিক্ষিত তরুণীদের বেছে নিচ্ছে। যাতে করে সংগঠন আরও শক্তিশালী হতে পারে। এজন্য নতুন কর্মী সংগ্রহ, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে এই অনলাইনের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকা থেকে জোবাইদা গ্রেফতারের হওয়ার আগ পর্যন্ত সিটিটিসির ধারণা ছিল, তারা যাকে খুঁজছে, তিনি পুরুষ। কিন্তু গ্রেফতারের পর পুলিশ আশ্চর্য হয়ে যায় প্রশিক্ষিত এই তরুণী জঙ্গিবাদের আদর্শ জড়িয়ে পড়ছে। তখন পুলিশের ধারণা হয়ে যায়, পুরুষের আড়ালে নারীদের জঙ্গি আদর্শে জড়ানো চেষ্টা চালাচ্ছে আনসার আল ইসলাম। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জেনেবুঝেই আনসার আল ইসলাম নারীদের তাদের দলে ঢুকাচ্ছে বলে তাদের আশঙ্কা। আরও নারী এই সংগঠনে যুক্ত হয়েছেন কিনা, খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত নাবিলা জানায়, সে ২০২০ সালের প্রথম দিকে নিজের নাম পরিচয় গোপন করে ছদ্মনামে একটি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খোলে। এক সময় সে ফেসবুকে আনসার আল ইসলামের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ ‘তিতুমীর মিডিয়া’র খোঁজ পায়। তখন সে ওই পেইজে যুক্ত হয়ে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন উগ্রবাদী ভিডিও, অডিও এবং আর্টিকেল সম্পর্কে ধারণা পায় এবং তাদের মতাদর্শ নিজের ভেতরে লালন করতে শুরু করে। তিতুমীর মিডিয়ার পেইজ এডমিনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। পরে সেই পেইজ এডমিন তাকে উগ্রবাদী জিহাদী কন্টেন্টসহ আনসার আল ইসলামের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটগুলোর লিংক দেয়। এভাবে ধীরে ধীরে ওই তরুণী আনসার আল ইসলামের মতাদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার কাজে যুক্ত হন।
ডিএমপি মিডিয়ার সেন্টারে এক সংবাদ সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান জানান, সে আনসার আল ইসলামের মতাদর্শ প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে টেলিগ্রাম মাধ্যম ব্যবহার করত। টেলিগ্রামে তার চারটি এ্যাকাউন্ট এবং সেই টেলিগ্রাম এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৭টির বেশি চ্যানেল সে চালাত। এসব চ্যানেলে সে আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন উগ্রবাদী সহিংস ভিডিও, অডিও, ছবি ও ফাইল শেয়ার করত। ‘জিহাদ কেন প্রয়োজন’, ‘কিতাবুল জিহাদ’, ‘একাকী শিকারি লোন উলফ’, ‘স্লিপার সেলগুলোতে গোয়েন্দাদের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের উপায়’, ‘নীরবে হত্যার কৌশল’, ‘পুলিশ শরিয়তের শত্রু’, ‘আল আনসার ম্যাগাজিন ইস্যু’, ‘জিহাদের সাধারণ দিক নির্দেশনা’, ‘তাগুতের শাসন থেকে মুক্তির ঘোষণা’ ইত্যাদি উগ্রবাদী বই বিভিন্ন সময়ে নাবিলার টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলো থেকে প্রকাশ করা হতো। সিটিটিরিস প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, নাবিলা আনসার আল ইসলামের বিভিন্ন অফিসিয়াল ও আন-অফিসিয়াল চ্যানেলেও যুক্ত ছিলেন। সেসব চ্যানেলে আইইডি, স্মোক বম্ব, আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করা এবং বিভিন্ন হামলার কৌশলগত বিষয় নিয়ে ‘ভিডিও ও ফাইল শেয়ার করত নাবিলা। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নাবিলা জিহাদের ময়দানে অংশগ্রহণের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। এমনকি সম্প্রতি তার বিয়ের কথাবার্তা চললে সে ছেলেপক্ষকে জানায়, জিহাদের ময়দানে ডাক এলে সে সামনের সারিতে থাকবে। এমনকি শহীদী মৃত্যু এলেও সে পিছু হটবে না। ছেলেও যদি এমন মতাদর্শের না হয়, সে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দেয়। নাবিলার টেলিগ্রাম চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারদের মধ্যে কোন নারী আছেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান জানান, সাবস্ক্রাইবার কোন নারী থাকতে পারে। আমরা মূলত তরুণদের টার্গেট করে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করছি। সে কণ্ঠের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সকলকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করত। তার জঙ্গিবাদে জড়ানোর ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা কী ছিল জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান জানান, পরিবার চেষ্টা করেছিল তাকে জঙ্গিবাদ থেকে দূরে সরিয়ে আনতে। কিন্তু পারেনি। পরিবারের অমতে তিনি এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়ানোর কথা বলে বেরিয়ে পড়েন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী শতাধিক ওপরে আইডির মাধ্যমে তরুণদের জঙ্গিবাদের আদর্শ উদ্বুদ্ধ করেছে। যারা জঙ্গি রিক্রুটমেন্টের সঙ্গে জড়িত আছে, তারা এসব আইডি খুলে জঙ্গিবাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এরকম কয়েকটি ফেসবুক আইডির সন্ধান পেয়েছে তদন্ত সংস্থা সিটিটিসি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সদস্য অনলাইনে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করে চলছে। এর ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। অনলাইন ব্যবহার করে নাশকতার উদ্দেশে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছে জঙ্গি সদস্যরা। হামলা বা নাশকতার সক্ষমতা না থাকলেও সংগঠনকে পুনর্গঠন করতে অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে আনসার আল ইসলামসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো। এতে নারীরা এই জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বড় কোন হামলা বা নাশকতা ঘটানোর সাংগঠনিক সক্ষমতা জঙ্গি সংগঠনগুলো নেই। তবে জঙ্গি সদস্যরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। পুনর্গঠন করতে ও সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থের জোগানে আনলাইনে এক্টিভ রয়েছে জঙ্গি সদস্যরা। এদিকে তাদের কার্যক্রম প্রতিতহত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মনিটরিং অব্যাহত রেখেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, অনলাইনে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। এর ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। এসব জঙ্গি সংগঠন অনেকটাই নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়েছে। তারা জানান, দেশে বড় কোন হামলা বা নাশকতা ঘটানোর সাংগঠনিক সক্ষমতা জঙ্গি সংগঠনগুলো নেই। তবে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গি নাবিলা গ্রেফতারের পরই পুলিশ এখনও নড়েচড়ে বসেছে। নারীরা জঙ্গি সংগঠনগুলো জড়িয়ে পড়ছে।