কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনার কারণে দীর্ঘ ১৭ মাস বন্ধের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের হতাশা কাটানো ও মানসিক বিকাশে দ্রুত সময়ের মধ্যেই সরকারী নির্দেশনা মেনে খুলে দেয়া হচ্ছে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আগামী মাসের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী কলেজগুলোতে পরীক্ষা নেয়া হবে। আগামী নবেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতিও চলছে পুরোদমে। সশরীরে পরীক্ষা নিতে ইতোমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান থেকে। এই এ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। পরীক্ষার জন্য কলেজ ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো করোনা শনাক্ত হয়। অতিমারী করোনার সংক্রমণ রুখতে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন মেয়াদে এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি অব্যাহত থাকবে। একটানা দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বিভিন্ন পর্যায় থেকে দ্রুত প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৮ আগষ্ট অনুষ্ঠিত সচিব সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দেয়ার নির্দেশনা দেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শতভাগ শিক্ষক উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পক্ষ থেকে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার উপযুক্ত রাখতে মাউশি থেকে আঞ্চলিক পরিচালকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, সব শিক্ষককে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সহকারী উপজেলা ও থানা শিক্ষা অফিসারদের এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত বিদ্যালয় পরিদর্শন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা যদি সমস্ত বিদ্যালয় পরিদর্শন না করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমরা চাই না বিদ্যালয় বন্ধ থাকুক। বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন ও কলেজ) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং বিদ্যালয় খোলার সার্বিক প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে আঞ্চলিক পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছি। সরকারের উর্ধতন পর্যায় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি খোলা যাবে। তাছাড়া আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাই রয়েছে। নিয়মিত এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া এবং তা নেয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান সাধারণ ছুটি আরেক দফা বাড়ানো হতে পারে। সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের বেশি এবং সংশ্লিষ্টদের টিকা দেয়ার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় এমনই চিন্তাভাবনা চলছে। তবে বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর মাসেই সচল হবে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারী কলেজগুলোতে বর্ষ পরিবর্তন ও ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর করোনা সংক্রমণের হার কমলে পর্যায়ক্রমে কলেজের পর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে খুলে দেয়া হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি আগেই নিয়েছিল দুই মন্ত্রণালয়। তবে কয়েক দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর নতুন করে খোলার সার্বিক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার নির্দেশনা দিলে নতুন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে সহকারী উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে শতভাগ বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে হবে। ওয়ার্কশীট বিতরণ শতভাগ নিশ্চিতকরণ ও যাচাই করতে হবে। শিখন ঘাটতির অবস্থা ও ফিডব্যাক নিতে হবে। বিদ্যালয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থী প্রোফাইল শতভাগ হয়েছে কিনা তা দেখা। দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য করণীয় নির্ধারণ করা। নমুনা হিসেবে শিক্ষার্থীর বাড়ি যাওয়া এবং শিক্ষার্থী যোগাযোগ নিবন্ধন যাচাই করা।
এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও দুই মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের মাস্ক ব্যবহার, বিদ্যালয়ে সাবান বা স্যানিটাইজার ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এছাড়া বিদ্যালয়ের প্রতিটি কক্ষ, ওয়াশ ব্লক ও আঙিনা পরিষ্কার রাখাসহ যাবতীয় প্রস্তুতি রাখার নির্দেশনাও ছিল।
জানা গেছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেপ্টেম্বরেই সচল হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজে ১ সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৮ সেপ্টেম্বর থেকে মাস্টার্সের স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। এভাবে অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটি পরীক্ষা নিচ্ছে, আবার কোনটি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি সূত্র বলছে, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টিকা দেয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় টিকার আওতায় এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের ৮০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী টিকার আওতায় এসেছে। সেজন্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এছাড়া কলেজ ও প্রাথমিক শিক্ষকদের বেশিরভাগই বর্তমানে টিকার আওতায় এসেছেন। তাদের পরিবারের সদস্যদেরও টিকার আওতায় আনা হচ্ছে। কিন্তু বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে কলেজ ও স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সবাইকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া করোনা সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে না আসা পর্যন্ত স্কুল পর্যায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। সে হিসেবে স্কুলে ছুটি আরেক দফা বাড়ছেই বলা চলে। আগামী ৩১ আগষ্টের আগেই এই সংক্রান্ত নির্দেশনা আসবে।
তবে স্কুল খোলার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেছেন, স্কুল খোলার সব প্রস্তুতি আমাদের আছে। এ মুহূর্তে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে আগামীকালই আমরা সরকারী প্রাইমারি স্কুলগুলো খুলে দিতে পারি।
মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। জাকির হোসেন বলেন, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খোলার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। স্কুলগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষকরা স্কুলে যাচ্ছেন। আমরা অনলাইন ও অফলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছি। সংসদ টিভিতে ক্লাস হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকলেও আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। তাদের ওয়ার্কশীট দেয়া হচ্ছে। স্কুল কবে খুলবে- এ প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্কুল খোলার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা লাগবে। এখন যে পরিস্থিতি, হুট করে তো স্কুল খোলা যায় না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন। স্কুল খোলার বিষয়ে আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। প্রধানমন্ত্রী যদি আজ নির্দেশনা দেন আমরা আগামীকাল থেকেই স্কুল খুলতে প্রস্তুত আছি।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বিশিষ্টজনরা স্কুল খোলার বিষয়ে মত দিচ্ছেন। কারণ গত দেড় বছর বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না। তারা নানা ধরনের কর্মকান্ডে যুক্ত হচ্ছে। অনলাইনেও আমাদের কিছু সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বাজে গেমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। স্কুল বন্ধ থাকায় প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ে বেড়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্কুল খুললেও আপাতত দুই ভাগে হবে প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের ক্লাস। এর মধ্যে ক্লাস থ্রি, ফোর ও ফাইভে সপ্তাহে ২ দিন করে ক্লাস নেয়ার পরিকল্পনা আছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাস সপ্তাহে একদিন করে নেয়া হবে। এভাবে আমরা করতে চাচ্ছি। আমাদের পাঠ্যসূচী অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত একটা সিলেবাসও চিন্তা ভাবনা করছি।
সমাপনী পরীক্ষার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সমাপনী পরীক্ষা সশরীরে হবে নাকি মূল্যায়নভিত্তিক হবে এ সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি অনুযায়ী নেয়া হবে। এ রকম যদি পরিবেশ থাকে তাহলে পরীক্ষা না নিয়ে আমরা গতবার যেভাবে মূল্যায়ন করেছি সেভাবে করব। আমরা তো ওয়ার্কশীট দিচ্ছি। এই ওয়ার্কশীটগুলোই আমরা মূল্যায়ন করব। এই শীট অনুযায়ী বাচ্চারা কে কী করল, সেভাবেই মূল্যায়ন করব। স্কুল খুললে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই। আমরা যদি স্কুল খুলতে পারি তাহলে অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পরীক্ষা নেব।