শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৭ মাস, হতাশায় শিক্ষার্থীরা ॥ ৪১ লাখ শিক্ষার্থীকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা ॥ ‘সুরক্ষা এ্যাপে’ ১৮ বছর বয়সীদের নিবন্ধনের সুযোগ

26

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পরই শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছরের ১৭ মার্চ বন্ধ ঘোষণা করার পর বিভিন্ন সময়ে করোনার সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় অন্য সব কিছু স্বাভাবিক হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধই থাকে। অভিভাবকদের আকুতি আর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে বন্ধ থাকলেও দীর্ঘ ১৭ মাস স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে না যেতে পেরে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী অবস্থায় থেকে বয়োসন্ধিকালীন ছেলে- মেয়েরা হতাশায় ভুগছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে খুব শীঘ্রই সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় এনে যত দ্রুত সম্ভব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অভিভাবক থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষ। এর প্রেক্ষিতে আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৪১ লাখ শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনাও করেছে সরকার। কিন্তু টিকার মজুদের প্রেক্ষিতে সুরক্ষা এ্যাপে নিবন্ধিত টিকাপ্রত্যাশীদের পরিমাণ এত বেশি যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যপূরণ অসম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে টিকার মজুদ কিছুটা বাড়লেই শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শুরু হবে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, এসএসসি ও এইচএসসির প্রায় ৪১ লাখ শিক্ষার্থীকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করছি আমরা। তাদের জন্য কোন টিকা উপযোগী হবে তা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আমরা সেপ্টেম্বরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে চাই এবং নবেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে। বর্তমানে দিন দিন করোনা সংক্রমণের হার কমছে। কিছুদিন আগেও এই সংক্রমণের হার ছিল ৩০-৩২ শতাংশ। এখন সেটা কমে ২২-২৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে এই হার কমছে। আমরা আশা করছি, পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে নবেম্বরের মাঝামাঝি এইচএসসি এবং ডিসেম্বরের শুরুতে এইচএসসি পরীক্ষা নিতে পারব। আমাদের সেই প্রস্তুতি আছে।
একই কথা বলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) শাহেদুল খবির চৌধুরী। তিনি বলেন, ৪১ লাখ শিক্ষার্থীকে টিকা দিয়েই পরীক্ষায় বসাতে চায় সরকার। তাদের টিকা নেয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা শিক্ষার্থীদের বিশেষ ইউনিক আইডি দিয়েই টিকা দেয়া সম্ভব। তবে শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক-কর্মচারী সবাইকেই টিকার আওতায় এনে পরীক্ষা নিতে হবে।
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনা টিকার জন্য নিবন্ধন করার সুযোগ তৈরি হয়েছে সুরক্ষা এ্যাপে। কোভিডের টিকার নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা এ্যাপের ‘পরিচয় যাচাই’ অপশনে ১৮ বছর বা তদুর্ধ ছাত্রছাত্রীদের নিবন্ধনের জন্য নতুন একটি অপশন খোলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) পরিচালক ও এইচআইএস এ্যান্ড ই-হেলথের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডাঃ মিজানুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার থেকেই সুরক্ষা এ্যাপে এই অপশনটি চালু হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের জন্য ২৫ বা তদুর্ধই আছে এখনও। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য এটা ১৮ বছর বা তার উর্ধে করা হয়েছে।
২৬ জানুয়ারি টিকার জন্য নিবন্ধন শুরু হয় যখন তখন শুধু ৪০ বছর বা এর বেশি বয়সীরা নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছিলেন। ৫ জুলাই আগের চেয়ে আরও পাঁচ বছর কমিয়ে টিকার নিবন্ধনের জন্য যোগ্যদের বয়স ৩৫ বছর করেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর ১৯ জুলাই আরও ৫ বছর কমিয়ে ৩০ বছর এবং ২৯ জুলাই বয়সসীমা আরও ৫ বছর কমিয়ে ২৫ বছর করা হয়। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ১৮ বছর বয়সীরা নিবন্ধিত হতে পারবেন এবার থেকে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ১৬ আগষ্ট পর্যন্ত দেশে এখন পর্যন্ত টিকা মজুদ ছিল ৩ কোটি ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৭২০ ডোজ। এর মধ্যে ২ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৪৩ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। শনিবার নতুন করে এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা এসেছে আরও ৭ লাখ ৮১ হাজার। কিন্তু টিকা পেতে নিবন্ধিত রয়েছেন সাড়ে ৩ কোটির বেশি মানুষ। এই অবস্থায় ৪১ লাখ শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনা আদৌ সম্ভব কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডাঃ রোবেদ আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, টিকার মজুদ এবং টিকাপ্রত্যাশীদের পরিমাণের যে পার্থক্য তাই তো পূরণ করা অনেক কঠিন। দ্রুততম সময়ে টিকা না আসলে এ পার্থক্য বাড়তেই থাকবে। এমন অবস্থায় নতুন করে শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় নিয়ে আসা কি সম্ভব? তবে নিশ্চয়ই আমরা যখন টিকায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব তখন সব শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারব।
এদিকে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত সময় পার করলেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিন কাটছে চরম হতাশায়। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শোয়েব জিবরান বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিংহভাগ শিক্ষার্থী আসে গ্রাম থেকে। আর তাদের এক বড় অংশ আসে দরিদ্র পরিবার থেকে। পরিবার সর্বস্ব বিক্রি বিনিয়োগ করে সন্তানটিকে পড়তে পাঠায়। সে শিক্ষার্থীদের ওপর সব সময় মারাত্মক মানসিক চাপ থাকে। তাদের তাড়া থাকে দ্রুত পাস করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার। পরিবারের হাল ধরার। করোনার কারণে প্রায় দুই বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে আছে। অনলাইন নামক যে ব্যবস্থাটি জোড়াতালি দিয়ে চলছে তা না চলারই মতো। এই শিক্ষার্থীদের অনেকে হলে থেকে টিউশনি করতো। হল বন্ধ হওয়ার কারণে তাদের আশ্রয় ও রোজগার দুটোই গেছে। গ্রামে ফিরে বেকার সময় কাটাচ্ছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের হতাশার ভেতর ডুবে যাওয়ার কথা। পুরো একটা প্রজন্ম এভাবে করোনায় নয়, হতাশায় শেষ হয়ে যেতে পারে না। তাই টিকা গ্রহণের উচ্চ হার আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত খুলে দেয়া দরকার। একই দাবি জানান বিশিষ্ট নাট্যকার রুমা মোদক। তিনি বলেন, আমি নিজেও একটি কলেজের শিক্ষক। আমার দুই সন্তান স্কুলে লেখাপড়া করছে। আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি তাদের হতাশার গল্পগুলো। প্রায় প্রতিদিনই ছাত্ররা ফোন করে ক্লাস করতে চায়। অনলাইনে ক্লাসের কথা বললে এখন হাসে। শুরুতে আগ্রহ থাকলেও এখন আর অনলাইনে ক্লাসের আগ্রহ তাদের মধ্যে নেই। ঘরবন্দী জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে তারা। তাই সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীদের টিকা নিশ্চিত করে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হোক।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদেরও দাবি একই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ক সাহা বলেন, আমরা প্রায় সব বন্ধুই জগন্নাথ হলে থাকি। পড়াশোনার পাশাপাশি বেশিরভাগই টিউশনিসহ অন্য জীবিকা অর্জনের কাজও করি। আবার সামাজিক কর্মকান্ডেও অংশ নেই। এই যেমন আমাদের একটা গ্রুপ আছে আমরা রক্তদান কর্মসূচী পালন করি। করোনাকালে অনেকেরই প্লাজমা, জরুরী অপারেশনের জন্য রক্ত জোগাড়, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট তৈরিতে রক্তের জোগান দিয়েছি। কিন্তু করোনার অজুহাতে হল-ক্যাম্পাস দুটিই বন্ধ। গ্রামে গিয়ে কি আর এতদিন থাকা যায়? প্রথম কয়দিন এক বন্ধুর মেসে গিয়ে থেকেছিলাম। এখন এক আত্মীয়ের বাসায় আছি। হলে নিজেদের রুম থাকতেও দিনের পর দিন ভাসমান মানুষ হিসেবে ভাসছি। এভাবে কতদিন? অথচ দেখেন শপিংমল, দোকানপাট, হাট-বাজার সবই খোলা। শুধু আমরা শিক্ষার্থীদের জন্যই যত বাধা।
বাসায় বসে বসে নিজের বাচ্চার মানসিক অবসাদ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে অফিসে বসে দিনভর মন খারাপ করে অফিসে কাজ করেন সংবাদকর্মী শাহনাজ শারমিন। তিনি বলেন, আমার বড় মেয়ে অহনা আনজুম এইচএসসি ২য় বর্ষে উঠল এবার অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা দিয়ে। তার পুরো কলেজ জীবনটাই মিস হয়ে গেল করোনায়। এজন্য প্রায় সময়ই সে হতাশায় ভোগে। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে ২য় শ্রেণীতে পড়া ছোট মেয়ে আরিসা আনজুমের জন্য। তার জীবন করোনায় যে এমন হয়ে যাবে কিছুদিন আগেও ভাবিনি। সারাদিন ঘরের এককোনায় বসে থেকে তার কি যে কষ্ট হয় মা হয়ে আমি সেটা বুঝি। আমি যখন কর্মস্থলে যাই তখন এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যে দিনভর সেই চোখের চাহনি আমাকে পোড়ায়। কিন্তু স্কুল খোলার সময়ে এমনটি ছিল না। সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গেই স্কুলে যাওয়া, দুপুরে বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া করে টেলিভিশনে কার্টুন দেখে সন্ধ্যায় আবার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসা। রাতের খাবার খেয়ে আবার পরের দিনের হোমওয়ার্ক তৈরি। এমন নিয়মের জীবন উল্টাপাল্টা করে দিয়েছে এই মহামারী। আমরা বড়রা কাজের তাগিদে এখানে সেখানে গেলেও ওরা তো একেবারেই বন্দী জীবন কাটাচ্ছে। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ শতভাগ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক।