৫৫ মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি, সিরিজ বোমা হামলার ১৬ বছর

4

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে একযোগে ৬৩ জেলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) পরিকল্পিত সিরিজ বোমা হামলার আজ ১৬ বছর পূর্তি। ২০০৫ সালের এইদিনে বেলা ১১টার দিকে মুন্সীগঞ্জ ছাড়া সব জেলার প্রায় ৫০০ পয়েন্টে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চরম ঔদ্ধত্যে শক্তিমত্তা জানান দিয়েছিল জঙ্গিরা। দীর্ঘ ১৬ বছর আগের সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় এখনও ৫৫টি মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। বিচারের অপেক্ষায় থাকা মামলার আসামির সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৪শ’ জন। এই সিরিজ বোমা হামলার রায় প্রদান করা মামলাগুলোর ৩৪৯ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী, আধা-সরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে চালানো সেই হামলায় ৫ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলায় দুজন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। ভয়াবহ সেই ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে ইতোমধ্যে ৯৩ নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে ৩৩৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।
পুলিশ সদর দফতর ও র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার পরপরই সারাদেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি। যার মধ্যে ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০ জন। এবং গ্রেফতার করা হয় ৯৬১ জনকে। ১ হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
পুলিশ জানায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ৯৪টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এসব মামলায় ৩৩৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। এখন ৫৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায়। যার আসামি সংখ্যা হচ্ছে ৩৮৬ জন। এই সিরিজ বোমা হামলার রায় প্রদান করা মামলাগুলোর ৩৪৯ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ২৭ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়া হয়। এরমধ্যে ৮ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
এসব মামলায় খালাস পেয়েছে ৩৫৮ জন আর জামিনে রয়েছে ১৩৩ আসামি। এছাড়া ঢাকায় বিচারাধীন ৫টি মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ঝালকাঠি জেলার দুই বিচারককে হত্যার জন্য ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ছয় জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, সামরিক কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, চিন্তাবিদ আব্দুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ এবং সালাউদ্দিনকে ফাঁসি দেয়া হয়। বিএনপি জামায়াতের শাসন আমলে (২০০১ থেকে ২০০৬) সরকারী এমপি-মন্ত্রীদের মদদে সারাদেশে শক্ত অবস্থান তৈরি করে জঙ্গিরা।
২০০৫ সালের পরবর্তী সময়ে কয়েকটি ধারাবাহিক বোমা হামলায় বিচারক ও আইনজীবীসহ ৩০ জন নিহত হয়। আহত হয় ৪ শতাধিক। ওই বছরের ৩ অক্টোবরে চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবং লক্ষ্মীপুরের আদালতে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এতে তিনজন নিহত এবং বিচারকসহ কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। এর কয়েকদিন পর সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় তিনি এবং তার গাড়িচালক আহত হন। ১৪ নবেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় আত্মঘাতী জঙ্গিরা। এতে নিহত হন ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে এবং সোহেল আহম্মদ। এই হামলায় আহত হন অনেক মানুষ।
সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে ২৯ নভেম্বর গাজীপুর বার সমিতির লাইব্রেরি এবং চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে। গাজীপুর বার লাইব্রেরিতে আইনজীবীর পোশাকে প্রবেশ করে আত্মঘাতী এক জঙ্গি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এই হামলায় আইনজীবীসহ ১০ জন নিহত হন। নিহত হয় আত্মঘাতী হামলাকারী জঙ্গিও। একই দিন চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে জেএমবির আত্মঘাতী জঙ্গিরা বিস্ফোরণ ঘটায়। সেখানে রাজিব বড়ুয়া নামের এক পুলিশ কনস্টেবল এবং একজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। পুলিশসহ আহত হয় প্রায় অর্ধশত। ১ ডিসেম্বর গাজীপুর ডিসি অফিসের গেটে আবারও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সেখানে নিহত হন গাজীপুরের কৃষি কর্মকর্তা আবুল কাশেম। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন। ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নেত্রকোনা শহরের বড়পুকুর পাড় উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর অফিসের সামনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতী জঙ্গি দল। সেখানে স্থানীয় উদীচীর দু’নেতাসহ ৮ জন নিহত হন। আহত হয় শতাধিক।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় এই পর্যন্ত ২৭ আসামিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার মামলায় ফাঁসির আদেশ দেয়া হলেও এর মধ্যে ৮ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হলেও অপর আসামিদের দন্ড কার্যকর করা যায়নি। বাকি মামলাগুলো এখনও বিচারাধীন। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৪০০। একযুগের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বিচারকাজ শেষ হয়নি। মামলার সব আসামিকেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। কোন কোন মামলার যুক্তিতর্ক চলছে। আবার কিছু মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বিচারকাজে এই দীর্ঘসূত্রতা বিস্ময়কর। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য বিভিন্ন মহলের দাবি।
অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, জঙ্গিদের মদদ দেয়া কিংবা অর্থ সহায়তা দেয়া পর্দার পেছনের হোতাদের খুঁজে বের করতে কাজ করতে হবে। উদ্বেগের বিষয়, সেই সিরিজ বোমা হামলার সময় থেকে আজও জেএমবি আতঙ্কে ভুগছে অনেকে। নিষিদ্ধ ঘোষিত এই জঙ্গি সংগঠনটির কার্যক্রম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্মূল করতে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পলাতক, ছাড়া পাওয়া, জামিন পাওয়া জঙ্গিদের নিয়েও ভাবতে হবে। তাদের নতুন করে সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা ঠেকাতে হবে।
জঙ্গি দমনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ১৬ বছর আগের এই ঘটনায় দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও ওই সময়ে চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মাওলানা মতিউর রহমানসহ কয়েক মন্ত্রী বলেছিলেন, দেশে জঙ্গিবাদ মিডিয়ার সৃষ্টি। কয়েক বছর পর জঙ্গিবাদ ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তবে জঙ্গিদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা না গেলেও তাদের আগের সেই নেটওয়ার্ক কিংবা সক্ষমতা এখন আর নেই। বিগত বছরগুলোতে জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ (এবিটি) বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময় তারা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের সতর্কতার কারণে তাদের সেসব প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। ১৯৯৮ সালে আল কায়েদার অনুসরণে জেএমবি যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে শীর্ষ দুই নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাইয়ের ফাঁসির মধ্যদিয়ে জেএমবির প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছিল। পরে জেএমবির আমিরের দায়িত্ব পান হবিগঞ্জের সাইদুর রহমান। ২০১০ সালে তাকে গ্রেফতার করা হলেও তিনি এখনও পুরনো জেএমবির আমির হিসেবে বহাল। পরে জেএমবি দু’ভাগ হয়ে একটি গ্রুপ নব্য জেএমবি নামে আবির্ভূত হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজানে সেই নব্য জেএমবির সদস্যরাই হামলা চালিয়েছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজারে বোমা হামলার পরিকল্পনা নিয়েছিল নব্য জেএমবির সদস্যরা। ওই ঘটনায় ১৩ আগষ্ট সিলেট থেকে পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের গ্রেফতারের পর জঙ্গিদের নতুনভাবে হামলার কৌশল ও পরিকল্পনার বিষয়টিও জানতে পারেন গোয়েন্দারা। আগের মতো সংঘবদ্ধভাবে না করে লোন উলফ বা এককভাবে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তবে জঙ্গিরা চেষ্টা করে নিত্যনতুন কৌশল নিতে। কিন্তু আগের মতো সেই সক্ষমতা নেই তাদের।
পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের এআইজি মোঃ সোহেল রানা বলেছেন, সিরিজ বোমা হামলা ও পরের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করেছে যথাযথভাবে। সেই অনুযায়ী আদালতে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। বর্তমানে মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন। দেশকে জঙ্গিবাদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে সর্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। ফলে বর্তমানে জঙ্গি ও সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারপরও এ বিষয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবসময়ের জন্য সতর্ক থাকার এবং সামাজিকভাবে মানুষের সচেতনতারও কোন বিকল্প নেই বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।