স্পোর্টস ডেস্ক :
আফিফ হোসেন ধ্রুব যখন আউট হয়েছেন, ১১ ওভারে তখনও ৬৮ রান দরকার বাংলাদেশের। হাতে মাত্র ৩ উইকেট। ভরসা হয়ে একটা প্রান্ত ধরে আছেন সাকিব আল হাসান। সাকিব কি পারবেন এমন কঠিন পরিস্থিতিতে দলকে জেতাতে?
শঙ্কা ছিল, দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন টাইগার সমর্থকরা। কিন্তু বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার তো তিনি এমনি এমনি হননি! কঠিন পরিস্থিতি থেকে ঠাণ্ডা মাথায় দলকে বের করে আনলেন, রুদ্ধশ্বাস এক ম্যাচে শেষ ওভারে এনে দিলেন ৩ উইকেটের জয়।
হারারেতে যে জয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটা এক ম্যাচ বাকি থাকতেই নিজেদের করে নিতে পেরেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ ১২ বছর আগে, ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের মাটিতে ৪-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল টাইগাররা।
সিরিজ জেতার ম্যাচে এবার দুর্দান্ত লড়াই হলো। সাকিব যে ম্যাচের নায়ক, ব্যাটে-বলে। প্রথমে বোলিংয়ে ১০ ওভারে ৪২ রানে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। পরে ব্যাট হাতে দলের চরম বিপদে খেললেন ৯৬ রানের হার না মানা ইনিংস। মাঠ ছাড়লেন বীরের বেশে।
সাকিব নায়ক, তবে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও আলাদা প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখেন। অষ্টম উইকেটে যে সাকিবের সঙ্গে ৬৯ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে সঙ্গী ছিলেন তিনিই। ৩৪ বল খেলে এক বাউন্ডারিতে করেছেন ২৮ রান।
সাকিবের একটা আক্ষেপই থাকতে পারে, সেঞ্চুরিটা না পাওয়ার আক্ষেপ। তবে হাতে আসলে সময় ছিল না। শেষ দুই ওভারে ১২ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের, সেঞ্চুরি করতে সাকিবের ১০। তেন্দাই চাতারার ওই ওভারের শেষ বলে চার মারেন সাইফউদ্দিন।
শেষ ওভারে লাগে মাত্র ৩ রান। আর স্ট্রাইকে গিয়ে মুজারাবানিকে থার্ডম্যান এরিয়া দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দারুণ ম্যাচে জয়টাও নিজের ব্যাটের স্পর্শে রাখেন সাকিব। সেঞ্চুরি পাননি, তাতে কি? দলের কঠিন বিপদের মুখে ১০৯ বলে ৮ বাউন্ডারিতে গড়া সাকিবের ৯৬ রানের ইনিংসটি যে ছিল ডাবল সেঞ্চুরির চেয়েও মূল্যবান!
লক্ষ্য ২৪২ রান। মাঝারি রান তাড়ায় শুরুটা খারাপ ছিল না তামিম ইকবাল আর লিটন দাসের। ৯.৩ ওভারের উদ্বোধনী জুটিতে তারা তোলেন ৩৯ রান। প্রথমে আউট হন তামিম।
লুক জঙউইকে ড্রাইভ করতে গিয়ে পয়েন্টে সিকান্দার রাজার দুর্দান্ত ক্যাচ হন, ৩৪ বলে ৪ বাউন্ডারিতে বাংলাদেশ অধিনায়ক তখন ২০ রানে। এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি লিটন দাসও।
আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান এবার উচ্চাভিলাষী পুল খেলতে গিয়ে টপএজ হন। মিডঅনে সহজ ক্যাচ নেন ব্রেন্ডন টেলর। ৩৩ বলে ৪ বাউন্ডারিতে লিটনের ব্যাট থেকে আসে ২১ রান।
সেখান থেকে দলকে ভরসা দেবেন কি, উল্টো বিপদে ফেলে যান মোহাম্মদ মিঠুন। পরের ওভারেই জঙউইকে উইকেট উপহার দেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। শরীরের বাইরে খেলতে গিয়ে কভার পয়েন্টে ক্যাচ দেন (৩ বলে ২) মাদভেরেকে। ৫০ রানে ৩ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
এরপর মোসাদ্দেক হোসেন হন দুর্ভাগ্যজনক রানআউটের শিকার। ১৯তম ওভারের প্রথম ডেলিভারিতে এনগারাভার ওয়াইড বলটি উইকেটরক্ষক রেগিস চাকাভার হাত ফসকে গেলে এক রান নিতে চান মোসাদ্দেক, সাকিবও দৌড় দেন। কিন্তু মোসাদ্দেক (৫) স্ট্রাইকার এন্ডে পৌঁছানোর আগেই স্ট্যাম্প ভেঙে দেন চাকাভা।
৭৪ রানে ৪ উইকেট হারানো দলকে এরপর টেনে তোলার দায়িত্ব নেন সাকিব আর বরাবরের বিপদের ভরসা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। পঞ্চম উইকেটে ৫৬ রানের জুটি গড়েন তারা।
শেষ পর্যন্ত এই জুটিটি ভেঙেছে মাহমুদউল্লাহ (৩৫ বলে ৩ বাউন্ডারিতে ২৬) কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলে। আবার বিপদ ফেরত আসে বাংলাদেশের।
প্রমোশন পেয়ে ওপরে চলে এসেছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। মাদভেরেকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে মায়ের্সের ক্যাচ হন এই অলরাউন্ডার, মাত্র ৬ রান করে।
আফিফ হোসেন ধ্রুব উইকেটে এসে সাকিবকে সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ শট না খেলে সিঙ্গেলস-ডাবলসে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২৩ বলে কোনো বাউন্ডারি ছাড়াই ১৫ রান করা আফিফ শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি নিতে গিয়েই আউট হয়েছেন। সিকান্দার রাজাকে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে গিয়ে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে পড়েছেন। তাতেই ১৭৩ রানে ৭ উইকেটে পরিণত হয় টাইগাররা।
এর আগে তরুণ পেসার শরিফুল ইসলামের বিধ্বংসী বোলিং সত্ত্বেও বাংলাদেশের সামনে ৯ উইকেটে ২৪০ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর দাঁড় করিয়েছে জিম্বাবুয়ে।
টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় জিম্বাবুয়ে। আগে ফিল্ডিং করতে নেমে প্রথম ওভারেই দলকে উল্লাসে মাতিয়েছেন ডান হাতি পেসার তাসকিন আহমেদ। তার করা প্রথম ওভারের শেষ বলে কাট করতে গিয়ে পয়েন্টে দাঁড়ানো আফিফ হোসেন ধ্রুবর হাতে ধড়া পড়েছেন ডানহাতি ওপেনার তিনাশে কামুনহুকামুই।
টিমসেন মারুমার ইনজুরির কারণে এই ম্যাচের মূল একাদশে জায়গা পেয়েছেন কামুনহুকামুই। কিন্তু সুযোগটি কাজে লাগাতে পারলেন না তিনি। আউট হওয়ার আগে ৫ বল খেলে করতে পেরেছেন মাত্র ১ রান। সেই রানটিও এসেছিল আউটসাইড এজ থেকে।
তবে সাইফউদ্দিনের করা চতুর্থ ওভারে জোড়া বাউন্ডারিতে ১০ রান তুলে ড্রেসিংরুমে ইতিবাচক বার্তা দেন আগের ম্যাচে দলের পক্ষে একমাত্র হাফসেঞ্চুরিয়ার চাকাভা। তাসকিনের করা পরের ওভারের দ্বিতীয় বলে মিড অনে মাহমুদউল্লাহ ও ডিপ থার্ড ম্যানে মারুমানির ক্যাচ ছেড়ে দেন সাইফউদ্দিন।
অবশ্য জোড়া জীবন পেয়েও কিছুই করতে পারেননি মারুমানি। ষষ্ঠ ওভারে প্রথমবারের মতো আক্রমণে আসেন মিরাজ। প্রথম চার বল খেলেন চাকাভা। পঞ্চম বলে স্ট্রাইক পেয়েই বড় শটের চেষ্টা করেন মারুমানি। কিন্তু বল তার ব্যাট ও পা হয়ে আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। ফলে সমাপ্তি ঘটে ১৮ বলে ১৩ রানের ইনিংসের।
মাত্র ৩৩ রানে জোড়া উইকেট পতনের পর উইকেটে আসেন টেলর। শুরু থেকেই খেলতে থাকেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে। বিশেষ করে সাকিবের ওভারে ইনসাইড আউট শটে বাউন্ডারি কিংবা শরিফুল ইসলামের ওভারে ফ্লিক শটে ছক্কা মেরে নিজের কর্তৃত্বেরই জানান দেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক।
টেলরের আধিপত্য বিস্তার করা ব্যাটিংয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিটি এগুচ্ছিল পঞ্চাশ রানের দিকে। তবে ইনিংসের ১৬তম ওভারে নিজের চতুর্থ ওভার করতে এসে সরাসরি বোল্ড করে আগের ম্যাচে জিম্বাবুয়ের একমাত্র হাফসেঞ্চুরিয়ান চাকাভাকে সাজঘরে পাঠিয়ে দেন সাকিব। ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলিয়ে বল স্ট্যাম্পে আঘাত করান তিনি। আউট হওয়ার আগে ৩২ বলে ২ চারের মারে ২৬ রান করেছেন চাকাভা।
এরপরই প্রতিরোধ গড়ে দাঁড়িয়ে যান ব্রেন্ডন টেলর এবং ডিওন মায়ার্স। টেলর ৪৬ রান করার পর দুর্ভাগ্যজনক হিটআউট হন। বোলার ছিলেন শরিফুল ইসলাম। ডিওন মায়ার্সও বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন। ৫৯ বলে ৩৪ রান করে মায়ার্স আউট হন সাকিব আল হাসানের বলে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতে ক্যাচ তুলে দেন মায়ার্স।
এরপর হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন মাধভিরে। শরিফুল ইসলামের বলে তামিম ইকবালের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান ৫৬ করে। সিকান্দার রাজা কিন্তু মাধভিরের সঙ্গে ভালো একটা জুটি গড়েন। ৪৪ বলে তিনি করেন ৩০ রান। লুক জংউই ৮ রান করে আউট হন। তেন্দাই চাতারা ৪ এবং রিচার্ড এনগারাভা অপরাজিত থাকেন ৭ রান করে।
১০ ওভারে ৪৬ রান দিয়ে ক্যারিয়ারসেরা ৪ উইকেট নেন শরিফুল ইসলাম। ২ উইকেট নেন সাকিব আল হাসান, ১টি করে উইকেট নেন মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন এবেং তাসকিন আহমেদ।