কারাবন্দী জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কোন কার্যক্রম নেই

24

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দীর্ঘ ১৭ বছর আগে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ। সময় গড়িয়েছে অনেক, এরমধ্যে তিনি তার ভুলও বুঝতে পেরেছেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নাহিদ নিজেই এখন জঙ্গিবাদ প্রতিরোধেই কাজ করতে চান। কিন্তু তার সুপথে ফেরার কোনও পথও খোলা নেই। কারণ কারাবন্দী জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কোনও কার্যক্রমই এখনো নেওয়া হয়নি। অথচ জঙ্গিবাদ নিয়ে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকারীরা বলছেন, জঙ্গিবাদ দমনে হার্ড এপ্রোচ বা আভিযানিক কার্যক্রমের পাশাপাশি জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এত বছর পরেও কারাবন্দী জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার কোনও কার্যক্রম শুরু না করাটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়।
বাংলাদেশে নব্বই দশকের শুরু থেকেই উত্থান শুরু হয়েছিল হরকাতুল জিহাদের নামে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের, প্রথম দিকে যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আফগান ফেরত মুজাহিদরা। এই দশকের শেষভাগ থেকে শুরু হয় জঙ্গিদের সহিংস তৎপরতা। এর মধ্যেই জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবিসহ আরো একাধিক জঙ্গি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকার কঠোর আইন প্রয়োগ করে আসলেও গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার প্রাতিষ্ঠানিক কোনও কার্যক্রমই হাতে নেয়নি।
অথচ জেলে বসেই জঙ্গিদের আরও বেশি মোটিভেটেড, সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা, সাধারণ বন্দীদের জঙ্গিবাদে মোটিভেটেড করাসহ অর্থ সংগ্রেহর জন্য পেশাদার ডাকাতদের ব্যবহারের তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলার পর থেকেই এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার জঙ্গিকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আগে থেকেই কারাগারে রয়েছে আরও অন্তত হাজার খানেক জঙ্গি। যাদের অনেকেই জামিনে বের হয়ে আবারও জঙ্গি তৎপরতায় নাম লিখিয়েছে।
তবুও কারাবন্দী জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট কোনও কার্যক্রম নেই কেন?
যে সমস্ত অফিসাররা দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন তারা অনেকেই (জঙ্গিদের সঙ্গে) কথা বলেন, যদিও সেগুলো ততটা টেকনিক্যাল কথাবার্তা না। কিছুটা তাদের বোঝানোর মতো, সেটি করা হয়। এটা অবশ্যই পর্যাপ্ত না। তাদের (জঙ্গিদের) মোটিভেশনের কাছে খুবই অপর্যাপ্ত’ -এক প্রশ্নের জবাবে বলছিলেন কারা মহাপরিদর্শক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মামুন, যিনি গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
শীর্ষ এই কারা কর্মকর্তা জঙ্গিদের সুপথে ফেরাতে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম নেওয়া উচিত মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে টেকনিক্যাল পারসন তৈরি করার অবশ্যই দরকার আছে। এটা আমাদের চিন্তাভাবনায় আছে। আপনি জানেন যে আমাদের কারাগারে অনেক সংস্কারই করা হচ্ছে, সাংগঠনিক কাঠামো চেঞ্জ বা আমরা নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করছি এবং কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। আমি মনে করি আমাদের এ ধরনের (জঙ্গি) বন্দী থাকবে। আমাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনে এই ধরনের ইউনিট অর্থাৎ জঙ্গিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজড করাটা বাংলাদেশ জেলের জন্য খুবই জরুরি।’
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা কারাবন্দী জঙ্গিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজেশন বা সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। হার্ড অ্যাপ্রোচ বা আভিযানিক প্রক্রিয়ার বাইরে সফট অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে কারাবন্দী জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ইমাম বা ইসলামিক স্কলারদের সম্পৃক্ত করিয়ে জঙ্গিদের যে খ-িত ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও মতাদর্শ তা খ-ন করে বোঝানো হবে। সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও থাকবেন। ইতোমধ্যে অন্তত আটজন জঙ্গি সদস্যকে জামিনে বেরিয়ে আসার পর কাউন্সেলিং করানো হয়েছে এবং তাদের পরিবারকে পুর্নবাসন করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ পুলিশ অর্থাৎ কাউন্টার টেরোরিজমের পক্ষ থেকে যে প্রজেক্টটা নেওয়া হয়েছে, তা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। আমরা ওনাদের স্বাগত জানিয়ে, ওনাদের যেহেতু এই বিষয়ে এক্সপার্টিজ আছে, প্রজেক্টটা অনুমোদন হলে জঙ্গিদের সুপথে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে স্পেসিফিক করে কিছু একটা করা যাবে। আমরাও, মানে আমাদের কারা কর্তৃপক্ষও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপকৃত হবে’ -বলছিলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান মোমিন।
দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ করে আসা মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, সহিংস তৎপরতা লক্ষ্য না করা গেলেও উগ্রপন্থীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। জঙ্গি মনোভাবাপন্ন মানুষের বেড়ে যাওয়াটা সমাজের জন্য বিশাল হুমকি। যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক জঙ্গিকে গ্রেফতার করছে। কারাগারে হাজার হাজার উগ্রমতবাদের মানুষ বা জঙ্গি সদস্য যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের মূল গ্রোতধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এ সংক্রান্ত দৃশ্যত স্ট্রং কোনও কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যা খুবই দুঃখজনক ও আশ্চর্যের বিষয়।
তিনি বলেন, কারাগারগুলোতে বন্দী থাকা জঙ্গিদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য সচেতনতা তৈরি বা কাউন্টার ন্যারেটিভ দিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ক্লোজলি মনিটরিং করতে হবে। একজন মানুষকে যতটা পারা যায় মূল গ্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।
সমন্বয়হীন জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ কার্যক্রমও
বাংলাদেশে বহু বছর ধরে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা মনে করা হলেও তা প্রতিরোধের কার্যক্রমে কোনও সমন্বয় নেই। এমনকি এখন পর্যন্ত জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জাতীয় কোনও কৌশলপত্রও তৈরি করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন সংস্থা বা বিভাগ নিজের মতো করে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছেন। জাতিসংঘর উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি ও ইউএসএইডের সহায়তায় বেশ কিছু এনজিও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কিছু কার্যক্রম চালিয়েছেন। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও পৃথকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কাজ করার ফলে প্রত্যাশা মতো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা।
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের এই কার্যক্রমকে দুনিয়াজুড়ে সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধ বা কাউন্টার বা প্রিভেনশন ভায়োলেটিং এক্সট্রিমিজম সিভিই কিংবা পিভিই নামে অভিহিত করা হয়।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সবসময়ই জঙ্গিবাদ দমনে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স নীতির কথা বলা হয়, কিন্তু সহিংস উগ্রবাদ দমনে জাতীয়ভাবে কার্যকর কোনও নীতি নির্ধারণী বডি বা সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা হয়নি।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলছেন, তারা জঙ্গিবাদ দমনে একটি ন্যাশনাল স্ট্র্যাটিজি বা জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করছেন। যেখানে প্রিভেনশন বা প্রতিরোধ ও আভিযানিক বিষয়ে বিস্তারিত বিষয় উল্লেখ থাকবে। কৌশলপত্রটি তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সাবমিট করবেন।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশে যখন কোনও জঙ্গি হামলা হয়, তখন অনেক তোড়জোর শরু হয়। হামলা না হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা এটি ভুলে যায়। যা জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে এটি একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে মহাপরিকল্পনা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তার বিপরীতে আমরা বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীন কিছু কাজ দেখছি। এভাবে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়।
হলি আর্টিজানে হামলা মামলার আসামিরাহলি আর্টিজানে হামলা মামলার আসামিরা
বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি হামলার পর নড়েচড়ে বসেছিল সরকার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দফতর ও বিভাগ তৎপরতা শুরু করেছিল। এর মধ্যে ধর্মমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মসজিদে মসজিদে খুতবার আগে ইমামদের দিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী বক্তব্য দেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদ বিরোধী কর্মসূচি, ইসলামিক স্কলারদের কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী ফতোয়া দেওয়া, পাঠ্য-পুস্তকে জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযোজন, কাউন্টার ন্যারেটিভ প্রচার-প্রচারণা অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে যে উগ্রবাদ নেই এবং সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রচার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্যত এখন কিছুই চলছে না।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তুক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলছেন, ‘আমরা যে একেবারে কিছুই করছি না তা না। পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ বিরোধী বক্তব্য কিছু কিছু যোগ করা হয়েছে। আরো বিশদভাবে সংযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।’
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলছেন, কোনঠাসা হলেও জঙ্গিরা কিন্তু থেমে নেই। তারা নিয়মিত অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের মতাদর্শ প্রচার করছে। সদস্য সংগ্রহ করছে। বড় করে আঘাত হানবার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্ট করছি।
কাউন্টার টেরোজিম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা হার্ড অ্যাপ্রোচ এবং সফট অ্যাপ্রোচ- দুইভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অধীনে একটি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন, জঙ্গি বিষয়ক গবেষণা, কাউন্টার ন্যারেটিভ এক্টিভিটিস, বিশেষ করে অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম সমানভাবেই চলছে।’
তিনি বলছিলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ৩৪টি জেলায় সচেতনতানমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জনপ্রতিনিধি, প্রত্যেকটি জেলার ইমাম-মুয়াজ্জিন, কারা কর্তৃপক্ষ সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে আমরা সচেতনতামূলক কাজ করেছি। করোনার কারণে কার্যক্রম বর্তমানে কিছুটা কম চলছে, কিন্তু চলমান রয়েছে।’
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, ‘আমরা অভিযানের পাশাপাশি এখন পর্যন্ত ১৬ জন জঙ্গিকে পুর্নবাসন করেছি। বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারদের সমন্বয়ে কোরআন হাদিস থেকে জঙ্গিবাদ বিরোধী ব্যাখ্যা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছিল। এছাড়াও আমাদের আরও অন্যান্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে।’