কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহামারী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে উল্লেখ করে নিজেকে ও পরিবারকে নিরাপদ রাখতে দেশবাসীকে সতর্ক ও সাবধানে থাকার আহ্বান জানিয়ে এ রোগের বিস্তার মোকাবেলায় সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন। দেশবাসীর উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। আমি সবাইকে অনুরোধ করব যেহেতু করোনায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ব্যাপকহারে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে গেছে, কাজেই সবাই একটু সাবধানে থাকবেন। নিজেকে নিরাপদ রাখবেন, নিজের পরিবারকে নিরাপদে রাখবেন, স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলবেন। নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন সেটা আমার বিশেষ অনুরোধ। এই অবস্থা (করোনা) আমরা মোকাবেলা করতে পারব ইনশাআল্লাহ। সে বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। এক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা আমরা চাই।
রবিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে কৃষি মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২৪’ প্রদান অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রতি এমন অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আর পিছিয়ে নয়, বরং আরও এগিয়ে যাবে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছে বলেই মানুষ মহামারীর মধ্যেও প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারছে এবং বাংলাদেশ উন্নয়নের দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং পুরস্কার বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন। এছাড়া পুরস্কার বিজয়ীদের পক্ষে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন মায়া রানী বাউল।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার ১৪২৪’ প্রদান করেন। যারমধ্যে রয়েছে ৫টি স্বর্ণপদক, ৯টি রৌপ্যপদক এবং ১৮টি ব্রোঞ্জ পদক। কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ৩২ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের মাঝে এই পদক বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলি সম্পর্কিত একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর কৃষিবিষয়ক ১০০ অমর বাণীর সঙ্কলন ‘বাণী চিরসবুজ’ ও স্মারকগ্রন্থ ‘চিরঞ্জীব’ এর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জাতির পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করেই আওয়ামী লীগ সরকার কৃষককে সব থেকে বেশি মর্যাদা দেয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সারের জন্য ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যার জন্য বিএনপি সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলে থাকা বিএনপি জাতীয় সংসদে বসে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের সমালোচনা করে এই বলে যে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ভাল নয়, কারণ বিদেশী সাহায্য পাওয়া যাবে না। যে কারণে ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি উদ্বৃত্ত খাদ্যের এই বাংলাদেশকে আবারও খাদ্য ঘাটতির দেশে পরিণত করে। এক ইউনিটও বিদ্যুত উৎপাদন না বাড়িয়ে উল্টো কমিয়ে ফেলে।
তিনি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসে তখন সরকারের জন্য আন্দোলনরত কৃষকদের গুলি খেয়ে মরতে হয়েছে, আর তার সরকার কয়েক দফায় সারের দাম কমিয়ে সার ও কৃষি ও উপকরণকে কৃষকদের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি সরকার সার চাওয়ার অপরাধে ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করেছিল। কৃষক সার চাইতে গেলে পেয়েছিল গুলি। তখন আমরা বলেছিলাম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সার কৃষকের ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে। আমরা সেই ব্যবস্থা নিয়েছিলাম এবং স্লোগান তুলেছিলাম ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’।
বর্তমান সরকার সারাদেশে এক শ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, এই এক শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে আমরা গুরুত্ব দিতে চাই কৃষিপণ্য বা খাদ্যপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে। কেননা এই করোনাকালে আমরা যদি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারি তাহলে নিজেদের চাহিদা যেমন মেটাতে পারব, তেমনি অন্যকেও সহযোগিতা করতে পারব। আর রফতানির ক্ষেত্রেও আমাদের পণ্য বৃদ্ধি করতে পারব। তিনি বলেন, ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ সবকিছুই আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে এটাকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে সেগুলো আমরা বিদেশে রফতানি করতে পারি। কাজেই প্রক্রিয়াজাতকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এই এক শ’টি বিশেষ অঞ্চলে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি সেখানে যেন কৃষি প্রক্রিয়াজতকরণ শিল্প গড়ে ওঠে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে ওঠে। যা আমরা বিদেশেও রফতানি করতে পারব। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করার বিশেষ অনুরোধও জানান।
খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অর্জনে সরকার ছয়টি থিমেটিক এরিয়াতে কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, কৃষি সম্প্রসারণ, সেচ কাজে পানির সাশ্রয় ব্যবহার, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবেলা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, আজ বিশ্বে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
কোন এলাকায় কোন ফসল ভাল হবে তা নির্ধারণে মাটি ও আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা এবং সফলতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, পতিত জমি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি, ৮০ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত জমি চাষাবাদের আওতায় নিয়ে এসেছি। ৮ লাখ ৮০ হাজার কৃষককে সবজি-পুষ্টি বাগান ও শস্য বহুমুখীকরণের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
বাংলাদেশ আর পিছিয়ে নয় এগিয়ে যাবে, এমনই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের জনগণের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ২০০৮ সালের পর থেকে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় থাকতে পারায় এবং আমরা হাতে সময় পাওয়ায় গবেষণায় যেমন উন্নতি করেছি, তেমনি দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পেরেছি। কেননা জাতির পিতা আমাদের এই স্বাধীন দেশ এনে দেয়ার সময় এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। সে চেষ্টা তার সরকার অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, কৃষি খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়নের জন্য আমাদের চাষী ভাই-বোনেরা যেমন কৃতিত্ব পাওয়ার দাবিদার, তেমনি আমাদের কৃষি বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণ কর্মীরাও সমান কৃতিত্বের অধিকারী।
তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম একটি মানুষও না খেয়ে মারা যাবে না এবং আল্লাহর রহমতে আমরা সেটা মোকাবেলা করেছিলাম। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে সার ও বীজ কৃষকদের হাতে পৌঁছে দেই এবং সব ধরনের সুযোগ দেই। উঁচু এলাকায় বীজতলা করে ফসলের চারা তৈরি করে এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টারের সহায়তায় দুর্গম এলাকার কৃষকদের মাঝে সময়মতো পৌঁছে দিতে পারার কারণে সেবারই বাংলাদেশ প্রথম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাকালে ২৩টি প্যাকেজের আওতায় তার সরকার ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে। যে কারণে এই মহামারী মোকাবেলা করে তার সরকার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারলেও জাতীয় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। করোনায় পুরো দেশের মানুষকে সরকার প্রদত্ত নানাবিধ সহযোগিতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রায় ৫ কোটির ওপরে লোক আমাদের সহায়তা পেয়েছে। কোন কাজকেই তার সরকার ছোট করে দেখে না উল্লেখ করে তিনি এ সময় কৃষকের ধান গোলায় তুলে দেয়ায় তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সারাদেশে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ভূমিকা তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধান কাটায় লোক পাওয়া যাচ্ছে না, কাজেই আমি যখন আমার ছাত্রলীগের ছেলেদের আহ্বান করলাম, আওয়ামী লীগ এবং সকল সহযোগী সংগঠন তাদের আহ্বান করার সঙ্গে সঙ্গে তারা কৃষকের সঙ্গে মাঠে নেমে ধান কেটে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। কাজেই আমি মনে করি, এই মানসিকতাটাই আমাদের জন্য দরকার-সব কাজকে সম্মানজনকভাবে দেখা এবং সবকাজে সবাই সম্পৃক্ত হওয়া, তবেই তো আমার দেশ এগিয়ে যাবে এবং আরও উন্নত হবে।
তার সরকার কৃষি খাতের প্রধান উপকরণসমূহ, বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি আমদানির ক্ষেত্রে এবারের বাজেটেও শূন্য শুল্কহার অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ভ্যালু চেইন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে পরপর তিনবার আমাদের জনগণ নির্বাচিত করায় দীর্ঘসময় পাওয়ায় গবেষণায় যেমন সাফল্য এসেছে, উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি সেই সেঙ্গ দেশকেও অর্থনৈতিকভাবে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। এই উন্নয়নের ধারাকে ধরে রাখতে তিনি দেশবাসীর অব্যাহত সহযোগিতা কামনা করেন।