ই-কমার্সের প্রতারণা ঠেকাতে লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক ॥ ইভ্যালি নিয়ে লড়েচড়ে বসেছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান

12

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সম্ভাবনাময় হলেও এখন সমালোচনার কেন্দ্রে দেশের ই-কমার্স (অনলাইনভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান)। বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হওয়ার অভিযোগ করছেন ক্রেতারা। প্রতারণার এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সম্পদের চেয়ে ছয়গুণ বেশি দেনা, যা পরিশোধের সক্ষমতা নেই কোম্পানিটির। এরপর নড়েচড়ে বসে বেশকিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
ইভ্যালিসহ ১০টি ই-কমার্স সাইট থেকে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ড দিয়ে কেনাকাটা স্থগিত করে ব্র্যাক ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ও ব্যাংক এশিয়া। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্ড ব্যবহার করে লেনদেনের বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করেছে ইউসিবি, সিটি ব্যাংক এবং লংকাবাংলা ফাইন্যান্স। অর্থাৎ পণ্য কেনার পর প্রতারিত হলে এসব প্রতিষ্ঠান দায়-দায়িত্ব নেবে না।
অন্যদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এখন থেকে ক্রেতাদের কাছে পণ্য ডেলিভারির পরই টাকা পাবে। সব লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বললে বাস্তবতার নিরিখে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও তাদের লেনদেন যাচাই-বাচাই করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সম্প্রতি এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শন টিম। যাচাই-বাছাই করে ওই টিম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।
তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ছয়গুণের বেশি দেনা পরিশোধের সক্ষমতা নেই ইভ্যালির।
ইভ্যালি যেসব কোম্পানির কাছ থেকে পণ্য কেনে, তাদের কাছে বকেয়া ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। চলতি সম্পদ দিয়ে গ্রাহক ও পাওনাদারদের বকেয়া অর্থের মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করা সম্ভব।
অর্থাৎ প্রায় ৮৪ শতাংশ বা ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার সমপরিমাণ দায় অপরিশোধিত থেকে যাবে। সব মিলিয়ে ইভ্যালির চলতি সম্পদের স্থিতি দিয়ে শুধু গ্রাহক দায়ের এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিশোধ করা সম্ভব।
এদিকে, এ অনলাইন শপিং সাইটগুলোর বিষয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর কিছু ব্যাংক তাদের কার্ড দিয়ে লেনদেনের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করেছে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যাদের নিয়ে স্থগিতাদেশ বা সতর্কতা দেয়া হয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, ইভ্যালি, আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট এবং নিডস ডটকম বিডি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন ও ক্রেতাদের বিভিন্ন অভিযোগ বিষয়ে শুক্রবার (২৫ জুন) দুপুরে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ই-কমার্স ইস্যুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানায় মার্কেটপ্লেসটি।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো ই-কমার্স নীতিমালা নেই। সেজন্য ইভ্যালি নিজেও দীর্ঘদিন অ্যাডভোকেসি করে আসছে। আজকের এ সিদ্ধান্ত সেই নীতিমালা প্রণয়নের প্রথম ধাপ বলেই আমরা বিশ্বাস করি। ফলে গ্রাহক, মার্চেন্ট, মার্কেটপ্লেসসহ পুরো ইকো-সিস্টেমই উপকৃত হবে।’
এর আগে ২৪ জুন ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা’ বিষয়ক সভা আহ্বান করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সভা শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মহাপরিচালক, ডাব্লিউটিও সেল) হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, ‘ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এখন থেকে ক্রেতাদের কাছে পণ্য ডেলিভারির পরই টাকা পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের এসব লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করবে। শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি এসওপি সার্ভিস ডেভেলপ করা হবে। যেন পণ্য ডেলিভারির আগে পেমেন্ট নেয়া না হয়।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংক বা ক্রেডিট কার্ড যাদের আছে, তারা পেমেন্ট কন্ট্রোল করবে। পেমেন্ট দেয়ার পর পণ্য ডেলিভারি হলে তারা যদি মেসেজ পায়, তারপর সেই পেমেন্ট কনফার্ম করবে।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার বলেন, ‘আমরা অ্যাসোসিয়েশন পলিসি নিশ্চিত করতে চাই, যেন প্রতিযোগিতামূলক বাজার থাকে। সেই জায়গা থেকে অনেক অভিযোগ হয়েছে, আমরাও সেটা মেনে নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ই-কমার্স বুমিং সেক্টর। এখানে ফিউচার আছে। দু-একটি কোম্পানির জন্য যেন গোটা ই-কমার্স সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিযোগিতা যেন একটা লেভেল প্লেয়িংয়ে থাকে, সেটাও নজরে রাখতে হবে। সুতরাং এসওপি হলে অনেক কনফিউশন দূর হবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত নয়। তারা অন্যসব ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করে। সেসব ব্যাংকের মধ্যে বেশকিছু ব্যাংক স্থগিতাদেশ দিয়েছে, সতর্ক করেছে।’
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা বিষয়ক সভা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি এসওপি সার্ভিস ডেভেলপ নিয়ে কথা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকে এসব বিষয়ে বললে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাস্তবতার নিরিখে যাচাই-বাচাই করে দেখবে।’